Sunday 18 August 2019

আজ সারাদিন বীরভূমের প্রাচীন ইতিহাসের গৌরবগাঁথা গ্রাম গুলির দু' একটি ঘুরতে ঘুরতে।
    যে গ্রামটি ঘুরে এসেছি সে গ্রামের ইতিহাস। বীরভূমে প্রকাশিত নয়াপ্রজন্মে।

লাল মাটির গ্রাম ঘুড়িষা, অতীত বীরভূমের বাণিজ্য নগর//     রাধামাধব মণ্ডল

বীরভূমের প্রাচীন গ্রাম ঘুড়িনগর আজ ঘুড়িষাগ্রাম। লোক ইতিহাসের আঁতুড় ঘর। প্রাগৈতিহাসিক যুগের যে ক'টি গ্রাম রয়েছে রাঢ় বাংলায়, তাদের মধ্য একটি গ্রাম বীরভূমের ইলামবাজার থানার ঘুড়িষা। সুদীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগেও এ গ্রামের অস্তিত্ব ছিল। ১৯৭৫ খ্রীস্টাব্দে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা পরেশনাথ দাশগুপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় এসে তাম্রযুগের নিদর্শন উদ্ধার করেন। এবং প্রাচীন বসবসক্ষেত্রটি চিহ্নিত  করেন। প্রাচীন প্রস্তর যুগের যে গ্রামের অস্তিত্ব নানান কালপর্বের গৌরব অগৌরব গাঁথার মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে, আজও তার অস্তিত্ব গ্রামে গেলেই চোখে পড়ে।  গ্রামটির প্রাচীন নাম ছিল ঘুড়িনগর। এ তথ্য মেলে রায়পুরের জমিদার বাড়ি থেকে। তবে মধ্যযুগেও এগ্রাম ছিল স্বমহিমায় বিরাজমান একটি নদী কেন্দ্রিক সভ্যতার বাণিজ্য নগরী। মধ্যযুগের আগে এই গ্রামেরই নাম ছিল তিনোড়, পরবর্তী কালে শ্রীবৃদ্ধির কারণে গ্রাম নাম হয় শ্রীপুর। আরও পরে গ্রামনাম পাল্টেছে নানা সময়ে। ইছাপুর, শ্রীপুর, হরিহরপুর ও তিনোড় আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে অবলুপ্তির পথে। যদিও আজও তিনটি মৌজা নাম হয়ে ইতিহাসের কালোস্রোতে ভাস্মর তিনোড়, ইছাপুর, শ্রীপুর।  এ গ্রামেই একদা রায়পুরের জমিদার সুভাষীনি দাসীর কাছে সুপরামর্শ নিয়ে "মুন্সীওয়ালা''রা সুজুনি কাঁথার ব্যবসা শুরু করেন। যা প্রাচীন অজাবতী, আজকের অজয় নদী পথ ধরে সুদূর কটদ্বীপ হয়ে বহিঃবঙ্গের নানা সীমাক্ষেত্রের উপর দিয়ে ওপাড় বাংলা ও অন্য মুলুকে পৌঁছে যেত সে কাঁথা। তবে সুজুনি কাঁথার পাশাপাশি, তাঁতিদের তাঁতঘরেরও রমরমা ছিল এ গ্রামটি। সেই সঙ্গে অতীত শিল্পের গ্রামীণ ধারাকে ধরে রেখে আজও শতাধিক পরিবার বন তাল ও খেজুর পাতার " তালাই'' শিল্প কে জীবন ও জীবিকা করে নিয়েছে।  নবাব আলীবর্দি খাঁ বর্ধমানের "রমনগড়ে'' অবস্থান কালে বর্তমান ঘুড়িষা গ্রামের ফকিরদের গান ও শীতলপাটি তালাই কিনে এনে মুগ্ধ হন। এবং রাজদরবারে ফিরে গিয়ে তিনি গ্রামীণ মহিলা এই শিল্পীদের তারিফ করেন।  এ গ্রামের কামরুননেশা বিবি শুধু তালাই বুনে শান্তিনিকেতনের কয়েক জন মানুষের  মাধ্যমে সুদূর লণ্ডনে ঘুরে আসেন।  গ্রামের (বর্তমান ) শ্রীপুর মৌজায় রাজা লক্ষণ সেন প্রতিষ্ঠিত " সায়েড়'' পুকুর এখনও রাজার নামে "লক্ষণ সায়েড়'' হিসাবে রয়েছে।  সেন রাজাদের যে একদা এঅঞ্চল মুক্তাঞ্চল ছিল তার প্রমাণ মেলে " সেনখা'' নামের পুকুরটি থেকে। সেনেদের খনন করা পুকুরটি থেকেই "সেনখা'' বা " সেনকা'' হয়েছে।  এটিও শ্রীপুর মৌজায় অবস্থিত একটি পুকুর। এছাড়াও গ্রামে এখনও রয়েছে "দেউল'' পুকুর।
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের নানান ইতিহাসে মোড়া গ্রামটিতেই রয়েছে " বড়ো মঠের রঘুনাথে''র চার চালা নয়নশোভান মন্দির। মন্দির টি ১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে,  বাংলার ১৫৫৫ শকাব্দে নির্মিত হয়। গ্রামের প্রবীণ আব্দুস কামাল, আব্দুস সামাদরা জানান, ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গীরা এ মন্দিরের দেবতাকে হরণ করে নিয়ে যান। পরবর্তী কালে দীর্ঘ সময়কাল এমন্দির দেবতা শূন্য থাকার পর,  শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুদৃশঢ় ও প্রাচীন কারুকাজে বোনা এই মন্দিরটি বীরভূমের গৌরবকে ধরে রেখেছি।  মন্দিরের খচিত লিপিতে উল্লেখ্য রয়েছে -
           রঘুওমাচার্য বিচিত্র মন্দিরম্
          রঘুত্তম প্রীতি সমৃদ্ধি বর্দ্ধনম্।
      হারাস্য কামাস্ত্র তিথি প্রবর্ত্তিতে,
শাকে বিনির্মিত; নমাম শিল্পীনা।।
  মন্দিরটি রঘুত্তম ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের উত্তর পূর্ব দিকের দুটি পথই অলঙ্কার সুদৃশ্য।  এবং দেব দেউলের পিছনের দিকে রয়েছে একটি ফলকে প্রতিষ্ঠা লিপি। দেউল গাত্রের অপূর্ব টেরাকোটা কাজে বোনা রয়েছে সে যুগের নানান পৌরাণিক কাহিনী। গ্রামে চলা পথে মেলে আরও একটি প্রাচীন মন্দির।  ১১৪৫ বঙ্গাব্দে ক্ষেত্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মন্দির।  মন্দিরে রয়েছেন গোপাল ও লক্ষ্মী-জনার্দনে শিলা। ইতিহাসের এই গ্রামে পনেরো হাজারেরও বেশি জনসংখ্যার মানুষ বসবাস করছে। সম্প্রতিক অতীতেও এগ্রামের সংস্কৃতি,  জেলার হারানো গৌরবের মালাতেও স্বর্ণ উজ্জ্বল দ্রুতি ছড়িয়ে রেখেছিল। জেলার নাট্যইতিহাসের প্রাণপুরুষ শিশুরাম অধিকারীও এগ্রামে আসতেন, তার নাটকের চর্চা নিয়ে। অতীতের সেই ধারাবাহিকতা নিয়েই গ্রামের সুকান্ত, নজরুল,  নেতাজী ও বিবাদী ক্লাব গুলি নাট্যচর্চায় একদা জেলার গৌরব গাঁথাকে ধরে রেখেছিল। ২৫-৩০ ফকিরদের বসতি রয়েছে গ্রামে। তারা নিয়মিত দেহবাদী গানের চর্চা করেন। গ্রামের নূর মহম্মদ শা ফকিরি গান গেয়ে দেশ বিদেশে যাচ্ছেন নিয়মিত।  শুধু তাইনয় নূর মহম্মদ শা বাংলার এপ্রজন্মের একজন প্রতিষ্ঠিত গায়ক। গ্রামের রামতনু ভট্টাচার্য জানান, আমার জ্যাঠামশাই  রামচরন ভট্টাচার্য ছিলেন সে সময়ে গ্রামের মাথা। তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে ভাতা দিত সরকার। ছোট বেলায় শুনেছি, আমাদের বাড়িতে বহু স্বদেশীদের আনাগোনা ছিল। বীরভূমের প্রাচীন টোল গুলির মধ্যে আমাদের বাড়ির টোলটিও ছিল।
বীরভূমের প্রাচীনতম এ গ্রামের নবরত্ন মন্দিরের অনুকরণই নাকি রাজা লক্ষণ সেন জয়দেবের মন্দিরা গ্রামে রাধামাধবের মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। অতীতের গ্রাম ছিল বাংলার ন্যায়, ব্রহ্ম, তর্ক শাস্ত্রের বিখ্যাত সব পণ্ডিতদের বসবাস ভূমি। বাংলার সে সময়কার সুবিখ্যাত পণ্ডিত রামময় পঞ্চতীর্থের সংস্কৃতের টোল ছিল এ গ্রামে। " মহামোহপাধ্যায়'' নামের এই সংস্কৃত চতুষ্পাঠী র খ্যাতি ছড়িয়ে ছিল, বাংলা মুলুকের বাইরেও। জানা যায় দেশ বিদেশের বহু ছাত্র এই চতুষ্পাঠী তে অধ্যায়ন করতে আসতেন। রামময় পঞ্চতীর্থের পিতা রামব্রহ্ম ন্যায়তীর্থ এই সংস্কৃত চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন।
ঘুড়িষার পরিচিত প্রাচীন দেবী " হংসবাহিনী'',  ধীবরদের হাতে পূজিত হয়ে আসছে। দশহারাতে এখানে বার্ষিক পুজো হয় এবং মেলা বসে। গ্রামের তিনোড় মৌজায় " হাঁদা রামেশ্বর'' নামের একটি প্রাচীন শিব মূর্তি রয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন এখানে বার্ষিক পুজো হয়। পানাগড় মোরগ্রাম (এন. এইচ- ৬০) জাতীয় সড়কের পাশ গ্রাম ঘুড়িষার অবস্থান। গ্রামের নোহনা বাঁধের ধারেই একদা ছিল ডাকাত রঘুর আস্তানা।  এ গ্রাম থেকেই ডাকাত সর্দার রঘু  আজকের দুবরাজপুর, অতীতের যুবরাজপুরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রঘুডাকাতের শ্মশানকালী এখনও রয়েছে। গ্রামের পরিচিত মুখ কামাল উদ্দিনের বাড়ির সামনেই রয়েছে একটি প্রাচীন বটগাছ। সেখানেই ধর্মদেবতার আটন। বুড়োরায় নামের ঐ ধর্মদেবতার থানেই অবহেলায় পরে রয়েছে জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি। কথিত আছে ধর্মতলার এই মাটির গুণে দেহের পুরোনো চর্মরোগ ভালো হত। আর এই মাঠের নাম ঘুড়ি বা কুড়িও বলেন কেউ কেউ। তা থেকেই গ্রাম নাম ঘুড়িষা হয়েছে ধরা হয়। কৃষি প্রধান বীরভূমের এই প্রাচীন লাল মাটির গ্রামকে নিয়ে জানার শেষ নেই।


No comments:

Post a Comment