Radhamadhab Mondal
Monday 9 August 2021
Wednesday 2 June 2021
বাঁকবদল
অতিমারি আবহে আসছে রাধামাধব এর "বাঁকবদল" | https://www.sangbadprabhati.com/2021/05/blog-post_67.html?m=1
Sunday 20 September 2020
[01/08, 10:03] Radhamadhab Mondal: টহল ১৬
রাঢ়ের টহলে মিশেছে সহজের ভাব//
রাঢ় বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি।
রাধামাধব মণ্ডল
রাঢ়ের টহলকে জাগিয়ে রেখেছে সহজভাব! একদিকে তার সঙ্গে যেমন মিশেছে প্রাচীন ধারা, ঠিক তেমনই মিশেছে তত্ত্বগত দিকটিও। আর এ-সবকে ছাপিয়ে, লোক গানের একটি রেশ গড়িয়ে গেছে টহলের ভিতরে। রাঢ়দেশীয় টহলের সংস্কৃতিতে মিশেছে ঝুমুর, ভাটির সুরও।
গোরা পদ কোকনদ
যার প্রাণ সম্পদ
মনে মনে স্মরি সে নিতাই;
যার হরি হুঙ্ক
গোরা এল নদীয়াতে
সে অদ্বৈতের বলিহারি যাই।
#
যার হরি কৃপা করি
ষড়ভূজ গৌরহরি
সে শ্রীবাসের নিতি গুণগাই ;
যারে লয়ে বাম পাশে
প্রেমরসে গোরা ভাসে
কান্তাভাব মাগি তার ঠাঁই।
#
যার হরিনাম শুনি
তুষ্ট গোরা গুণমণি
ভক্তি রত্ন মিলে যার কৃপায়;
শ্রীহরিদাসের দাস
এ রাধাময় করে আশ
নিত্য যেন গৌর সেবা পাই।
(দাস রাধাময় এর গান)
টহল শিল্পীদের গ্রাম বলতে রাঢ় বাংলার বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদীয়াই প্রধান। তবে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার একটি অংশে এবং হুগলী, মেদিনীপুর এলাকার পাশাপাশি দুই চব্বিশ পরগণা ও সেদিনের কলকাতা শহরে ছিল টহল শিল্পীরা। তাদের কোথাও টহল, কোথাও নামী, কোথাও হরিনামের দল, শিল্পী, সাধুসন্ন্যাসী বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
সব থেকে বেশি টহল শিল্পীর বসবাস, দুই বর্ধমান, বীরভূমের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে নদীয়াতেও। নদীয়ার নদেরচাঁদ গৌরই তো এই জেলা গুলিতে কখনো নিজে, কখনোবা শিষ্যসন্তদের দ্বারা শচিমাতার নন্দনের ঘুম ভাঙানোর জন্য প্রভাতী সুরে আপ্তসাধন কথা গানের সুরে ভিজিয়েছেন। তারও কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে ছিলেন তিনি নিতাইকে নিয়ে। সেই বৈষ্ণবদের বৈজ্ঞানিক ধারাটি আজও চলে আসছে। তবে কালের স্রোতে, সময়ান্তরের ধারায় সেই ধারাটিতে ছেদ পরেছে বারে বারে। তবুও আজও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, ক্ষীণ সুরে হলেও বাজছে বাংলার প্রাচীন লোকায়ত সুরের এই সাধন কাকলি।
বাংলার এই ধারার লোকসংগীতের চর্চার সঙ্গে সাধক ও সাধনার বিষয়টি কি ভাবে যুক্ত হয়েছে, সে নিয়ে অস্পষ্ট হলেও নানা মুণির নানা মত রয়েছে। তবে কি সে সময়ের বাংলায় ধর্মভাবের প্রাবল্যজনিত কারণেই এই ধর্মীয় ভাবটি, আজকের হারাতে বসা লোকসংগীতের এই ধারার শরীরের সঙ্গে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে গেছে। অন্তজ শ্রেণিতে এখনও ঢোকানো যায়নি টহলকে।শ্রেণিগত ভাবে, টহল গানকে আজও চিহ্নিত করতে পারা সম্ভব হয়নি, যে টহল গান মূলত অন্তজ শ্রেণির সাধনগান। অতীতে কেবলমাত্র বৈষ্ণবেরাই টহল গান গাইতেন আর গান বাঁধতেন কেবলমাত্র বৈষ্ণব সাধকরাই। তবে বর্তমানে জীবন ও জীবিকার নানা টানাপোড়নে অনেকেই টহল গাইছেন। ডোম, বাউড়ি, বাগ্দী, ভল্লা, রুইদাস, গড়াই, সদগোপ, ব্রাহ্মণ থেকে সমস্ত জাতির উপার্জন কম মানুষেরা টহল গান করেন, জীবিকার্জনের জন্য। তেমনই পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অজয় তীরবর্তী রাজা অমরেন্দ্রর অমরপুরের মঙ্গলপুর গ্রামের প্রধান বসবাসকারী জাতি বাউড়ি সম্প্রদায়ভুক্ত মেটেরা, খেতের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে বৈষ্ণবভাবে ভাবিত হয়ে তাদের অনেকে টহল গান করেন, কার্তিক মাসের ভোরে। সেই মঙ্গলপুর গ্রামে দীর্ঘ দিন ধরে টহল গান করে আসছেন ধংশো পরম্পরায় অমূল্ল মেটে, শ্রীধর মেটে, আনন্দ মেটে, মুরালী মেটে-রা। শুধুতাই নয় মঙ্গলপুর গ্রামের পাশেই অজয় নদ আর নদ পেরুলেই ইতিহাসের বাণিজ্য নগরী ইলামবাজার, সুখবাজার, একটু দূরে জনুবাজার, ভরাঙ্গী, টিকরবেতা, কেন্দুলী ও রামপুর। কয়েক বছর আগেও ইলামবাজার সুখ বাজারে টহল গান করতেন রাধা বৈষ্ণবী। তিনি এখন দেহ রেখেছেন। ইলামবাজারের লাগোয়া গ্রাম পায়ের, দেবীপুর, খয়েরবুনি। পায়ের গ্রামের প্রাচীন নাম পদচিহ্ন। কথিত আছে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য উৎকলদেশে যাওয়ার সময় এই পায়ের গ্রামে, পা রেখেছিলেন। তাই গ্রামনাম পদচিহ্ন থেকে পায়ের হয়েছে। সেই পায়ের গ্রামে রয়েছে মহাপ্রভু পার্ষদ কাশেশ্বর গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভু মূর্তি। তা আজও গোস্বামী বাড়িতে পুজিত হয়। গ্রামে রয়েছে বাউতি ভিটা। শোনা যায় পতিত সেই ভিটাতে একসময় বসবাস করতেন শ্রীখোল বাদক, জাগানোর গানের সাধক রসরঞ্জন বাউতি। তিনি নাকি উৎকলযাত্রায় মহাপ্রভুর সঙ্গে শ্রীখোল বাজিয়ে, কীর্তনে নেচেছিলেন।
সেই গ্রাম গুলোতে এক সময় টহল গান গেয়ে মাধুকরী করতেন বিখ্যাত বাউল শম্ভু দাস। যিনি পরবর্তী কালে গৌর খ্যাপার সঙ্গে বাহাস গেয়ে, খমক লড়াইয়ে মাততেন! তাঁর পুত্র গৌর দাস বাউল ও তার বড়ো ভাই বিশ্বনাথ দাস এবং ছোট ভাই নিতাইরা এখনও টহল গানের চর্চা করেন।
বীরভূমের রাজনগরের শিক্ষক সন্তোষ কর্মকার বললেন, আমার ব্লকের রাজনগর, ভবানীপুর, তাঁতিপাড়াসহ কম বেশি সব গ্রামেই এখনও কার্তিক মাসের ভোরে টহল গান হয়। তবে নতুন প্রজন্মের তেমন সাড়া নেই এই লৌকিক সংস্কৃতির চর্চায়। এখনও এই অঞ্চলে পুরোনো দিনের বোষ্টমরাই ধরে রেখেছেন টহলের চর্চা।
ইলামবাজার ব্লকের জয়দেব, সুগর, ভরাঙ্গী, জনুবাজার, রামপুর, বটচাতুরি, হাঁড়িপাড়া, বালারপুর, ভুবণেশ্বর, সন্তোষ পুর, টিকরবেতা ও শির্ষের মোড়াগাছি, উত্তরকোণা, খড়ুই, সুনমুণি, ঘুড়িষা, ধরমপুর, শালকা এই গ্রাম গুলোতে টহল গানের চর্চা রয়েছে, বললেন জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক রণজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি আরও জানান, জয়দেবের চার পাঁচটি গ্রামে টহল গান করেন নাড়ুগোপাল দাস, বাঁকাশ্যাম দাস, নিত্যানন্দ আশ্রমের অনিল মুখোপাধ্যায়রা। যদিও অনিলবাবু প্রাক্তন লাউদহা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তবুও তিনি এই লোকসংগীতের বিলুপ্ত ধারাকে নিয়ে চর্চা করেন। ধরমপুরে একটি আশ্রম আছে, যারা কালিদাস বাবাজির শিষ্য। তারাই শির্ষের গ্রাম গুলোতে টহল করে।
কবি প্রবীর দাস বললেন, ছোট বেলায় আমার জন্মগ্রাম নানুরের জুবুটিয়াতে কার্তিক মাসের প্রতিটি ভোরে, বৈরাগীরা টহল দিতো। পরের এপ্রজন্মের আনন্দ বাগ্দী এবং বি কম পাশ করা শিক্ষিত যুবক প্রভাত গড়াইও (কানাই) প্রতিদিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, কার্তিক মাস ধরে টহল গাইতো।
টহল গানের মূল উপজীব্য বিষয় বৈষ্ণব সাধনতত্ত্ব কে নিয়ে, গান গাওয়া। এই গানে বৈষ্ণব তত্ত্ব প্রসঙ্গ একবার যদি আসে, তাহলে তা আর যেন শেষ হতেই চাই না। সাধকরা বলেছেন, তত্ত্বও যে আপেক্ষিক, সেটা ভুললে হবে না। যেমন দেখতে হবে গৌড়বঙ্গে প্রচলিত বৈষ্ণবধর্মের আসল কেন্দ্রবিন্দু এখনও মানুষ। বৈষ্ণবী তত্ত্বে এই মানুষকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। ঠিক তখনই সমাজ, সংসারে ধর্মের গতিপ্রকৃতি ও তার তাৎপর্য নির্ণয় গৌণ হয়ে পড়ে।
সেই আদিকাল থেকে বৈষ্ণবদের ধর্মের কিছু গৌণ ধারা ছিল। কয়েকটি এখনও টিকে আছে। তেমনই একটি গৌণ ধারার বাহ্যিক রূপের প্রকাশ গীতই হল টহল। মনের আমিকে জাগানোর গান।
চিন্তার চিন্তনে সেই অস্তিত্বের আমিকে আহ্বান করা হয়, এই টহল গান দিয়ে। এই গুপ্ত গৌণ ধারার চর্চাক্ষেত্র এখনও বাংলার বহুগ্রাম।
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অমরপুরের ভোগাতলা, গোঁসাই বাগান, কালিকাপুর, মৌখিড়া গ্রামের টহল শিল্পী আকুলিয়া গ্রামের শিবু ঠাকুর। তিনিও তত্ত্ব কথার আগম রস জানেন। বীজের সাধনকথা তুলে আনেন গানের পদে।
একটি পরজীবী দেহকে নিয়েই অস্তিত্বের সাধনা করেন টহল শিল্পীরা। তবে এ সাধনায় প্রাণের অস্তিত্বের প্রকাশ ও বিকাশ রাখা জরুরি।
সামাজিক নানা খসড়াতে দেখা যায়, একটি পরজীবী শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ চলার পথে! এবার তাদের বড়ো দু'দিন আসছে! টাকার দামতো আর থাকবে না! এই সঙ্কটকালে থাকবে না সাহিত্য, সংস্কৃতি, আভিজাত্য, আধিপত্যের দামও! শুধু ভাতের দাম হবে এবার! ভাতের জন্য আবার একবার গোটা মানব সভ্যতা বাঁচতে শুরু করবে শত্রুতা!
বিদ্বেষ জাগরিত হবে, এবার কেবল ভাতের টানেই! সেই সঙ্কট কাল থেকে পথ দেখাতে বৈষ্ণবেরা প্রচার করছেন গৃহের সাধনা। গৃহের আপ্তসাধন গুণই আগামীকে পথ দেখাবে। তার একটি স্বচ্ছ ধারাকে, আবার জাগিয়ে তুলতে গৃহী সাধকদের বান আসা দরকার। তাই এই সঙ্কটের সময়ে প্রাচীন বৈষ্ণবীয় মহাজনরাই দেখাবেন পথ।
তাল তমালের শান্ত সমাহিত ছায়ায় অজয়ের তীর। ছোট ছোট প্রাচীন আখড়া, আশ্রমের সারি। অদূরে কদমখণ্ডী ঘাটে নশ্বরদেহ পুড়ছে! পঞ্চভূতে বিলীন হচ্ছে বর্তমান। আগামী ডেকে আনছে ভাববাদকে। তার পিছুপিছু আসছে সাধক বৈষ্ণব।
নন্দ গোঁসাই গাইছে গুনগুন করে, নিজের বাঁধা গান! "এ এক আজব দেশে/বাউল জন্মায় গানের বসে"! কেন গানের বসে? এক কায়া দেহ অজয়! আর সেই ধর্ষিত অজয়ের কোলে হাঁটতে হাঁটতে, এ-ই সব ছাইপাঁশ কথা ভাবতে ভাবতেই, বেলা নামে পশ্চিমের আকাশে! ওপাড় থেকে ভেসে আসে, তরুণীর চিৎকার। "বাবা, বেলা যে গড়িয়ে যায়, বাসনায় আগুন দিবি না!"
হঠাৎ কাঁদির লালাবাবুর কথা মনে পরে যায় তার, পিতার! চমকে ওঠে বৈষ্ণব সাধক। আত্মজাগরণের এই বাণীই কানে কানে, বেজে বেজে ঘুরে!
রাঢ় বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপ্তি দুর্নির্ণেয়! একদা দক্ষিণ বিহারে গয়া অবতার পূজনের একটি কেন্দ্র রূপে প্রসিদ্ধ ছিল। সে সময় সব শ্রেণির লোকরাই বৈষ্ণবধর্মের সমর্থক ছিলেন।
রাজন্যবর্গ, গৃহী, বণিকগণ, সরকারের কর্মচারিগণ বিশেষ ভাবে বিক্রমপুর পরগণার বারুজীবীগণ বিষ্ণুর অবতারের উপাসক ছিলেন।
সেনবংশের রাজাদের রাজত্ব কালেও বৈষ্ণবীয় ভক্তি ভাব তেমন কিছু স্পষ্ট ছিল না। রাজা বল্লাল সেন "দানসাগর" গ্রন্থে "ভাগবতপুরাণ" এর উল্লেখ করেছিলেন। দৈত্যনিসূদন বিষ্ণুর পুজো গুপ্ত বংশীয় সম্রাটদের সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার একটি প্রকৃত উদাহরণ রূপে গণ্য করা হতো। সুপ্রাচীন "ব্যূহবাদ" এর প্রভাব কিছুটা অস্পষ্টভাবে দেখা যায়। ভাগবত ধর্মও সে দিনের অভিজাত মহলে, শাসক শ্রেণিতে কিছুটা জনপ্রিয় ছিল।
অপরদিকে ত্রিপুরার ময়নামতিতে প্রাপ্ত রণবঙ্কমল্লের তাম্রলেখে ধর্মের অনুষঙ্গে "সহজ" শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যবহার থেকে ধারণা করা যায়, যে সহজিয়া বৈষ্ণবতারও কোনোও একটি ক্ষীণ ধারায় জীবিত ছিল। বৈষ্ণবরা বুদ্ধদেবকেও বৈষ্ণব অবতার রূপে শ্রদ্ধা করতেন। বঙ্গে সে দিনের ধর্মীয় সমন্বয়ের আদর্শ ছিলেন বুদ্ধ। তাই বহু প্রাচীন পন্থী টহল গানে বুদ্ধর ছায়া আছে।
নিত্যানন্দ নিত্যানন্দ, বুদ্ধ অবতার
তাহাদের মাঝে নাচে গৌরাগুণধর।
রাত গিয়ে প্রভাত আইলো,
শ্যামেরও সুহাগি
আচম্বিতে বাংলা ঘোরে, গৌরা গুণনিধি।
####### ########## ######## #####
প্রাচীর বৈষ্ণবধারার ঐক্য ধরে রেখেছিল "টহল"!
রাধামাধব মণ্ডল
আর কতো নিদ্রা যাওহে সখা, প্রভাতও হইলো
ওঠো ওঠো গৌরাচাঁদও, সুখ শারি ডাকে।
আর কতো নিদ্রা যাওহে সখা, বেলাযে পোহাইলো।
ওঠো ওঠো গৌরাচাঁদও, প্রেমমুরতি ওই ডাকে।
বাংলার বিভিন্ন জেলার মতো বর্ধমান জেলাতেও বৈষ্ণব ধর্মের তিনটি প্রধান ধারা প্রবাহিত হয়েছে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল পঞ্চোপাসনায় বিধৃত বৈষ্ণবধর্ম এবং বৈষ্ণবআচার।
পঞ্চোপাসনার অর্থে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে পঞ্চ দেবতার উপাসনাকে। সেই পঞ্চ দেবতারা হলেন বিষ্ণু, শিব, শক্তি, গণেশ ও সূর্য দেবতা।
বৈষ্ণবদের দ্বিতীয় ধারাটি হল গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম। এই ধর্ম শ্রীচৈতন্য অনুগামীদের মাধ্যমে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে প্রচারিত হয়েছিল।
বৈষ্ণবদের তৃতীয় ধারাটি হল লোকায়ত বৈষ্ণবধর্ম। এই ধর্মের কোনো কোনো মৌলিক সিদ্ধান্তের কথা কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর রচিত "চৈতন্য চরিতামৃত" থেকে গৃহীত হয়ে, আঞ্চলিক বিভিন্ন ধর্মীয় ভাব সেখানে ঢুকেছে। এই লোকায়ত বৈষ্ণবধর্মকে সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মও বলা হয়ে থাকে।
সেই ধর্মের বৃত্তে সহজ ভাবে নানান সামাজিক আচার বিচারও প্রবেশ করেছে। তেমন ভাবেই সহজিয়া বৈষ্ণবভাবে যেমন একসময় বাউল মিশেছে ঠিক তেমন ভাবেই বাংলায়, প্রাচীন এই বৈষ্ণবধারার সঙ্গে মিশেছে টহল সংগীত।
পরবর্তী কালে এক সময় বাংলাতে এই টহল সংগীতই লোকায়ত বৈষ্ণবদের সাধনসংগীত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
রাঢ় বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের এই ত্রিধারার স্রোতও বয়েছিল দীর্ঘ দিন। ত্রিধারার সঙ্গে শৈবশক্তি, শাক্তশক্তি, ধর্মপুজো, মনসাপুজো একই আসনে বসেছিল বাংলায়।
৫০০ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের মল্লসারুল গ্রামে একটি, তাম্রপত্রে রচিত লিপি উদ্ধার হয়। সেই লিপিতে চক্রক্ষেপনেরত বিষ্ণুর ছবি খোদিত ছিল। এবং লিপির ষষ্ঠচরণে কয়েকজন বৈষ্ণব ব্যক্তির নাম খোদিত ছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে মধ্য রাঢ়ের বর্ধমানে বিষ্ণুর অবতারের পুজো চালু ছিল।
ভাগবতপুরাণ কালক্রমে বর্ধমানে তথা রাঢ়দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয়। বৈষ্ণব ভাবাদর্শের ভিত্তি স্বরূপ এই পুরাণ আদি মধ্যকালে দাক্ষিণাত্যে সুশিক্ষিত শূদ্রা জাতিয় বৈষ্ণবদের হাত ধরে রচিত হয়। এবিষয়ে কোনো সন্ধেহ নেই।
বর্ধমানের কুলিনগ্রাম নিবাসী, বৃত্তশালী পরিবারের কায়স্থ বংশের মালাধর বসু "ভাগবতপুরাণ" অনুসারে "শ্রীকৃষ্ণ বিজয়" রচনা করে ছিলেন। জানা যায় মালাধর বসু সুলতানের দরবারে কর্মরত ছিলেন। বাংলার সুলতান বারবাক শাহ্ তাঁকে, "গুণরাজ খান" উপাধিতে সম্মানিত করে।
সে যুগের কুলিনগ্রাম, বর্ধমান জেলার একটি প্রাচীন গ্রাম। শ্রীচৈতন্যের সময়ে এই গ্রামে বৈষ্ণবধর্মের রমরমা তৈরি হয়। এবং গ্রামের সমস্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে এই বৈষ্ণবধর্ম জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রতি ঘরে সকাল সন্ধ্যে শ্রীখোল বাজতো। হতো নাম গান।
মালাধর বসুর পৌত্র রামানন্দ ছিলেন চৈতন্যর ধর্ম আন্দোলনের সঙ্গী। সে সময় এই গ্রামে গোপেশ্বর শিবও পুজো পেতেন।
মালাধরের পুত্র সত্যরাজ খান ছিলেন হরিদাসের পরিকর। যবন হরিনামও কিছুদিন কুলিনগ্রামে ছিলেন। এখনও কুলিনগ্রামে রয়েছে "হরিদাস গৌড়ীয় মঠ"। এই মঠে চৈতন্যকে পুজো করা হয়। আজও কথিত আছে, শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে গুণরাজ খান, পুরীতে রথযাত্রার সময় কুলিনগ্রাম থেকে ''পট্টদড়ি" পাঠাতেন। সুপ্রাচীন কুলিনগ্রামে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের পুজো আজও চালু রয়েছে। আজও পুরীতে দড়ি পাঠায় কুলিনগ্রাম।
সেই কুলিনগ্রামে এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল বৈষ্ণবদের জাগানোর গান বা টহল। এখনও কুলিনগ্রামের বহু মানুষ টহল গান করেন। বৈশাখমাসের সন্ধ্যবেলা কুলিনগ্রামে নামের বেড়া দেওয়া হয়, কার্তিকের ভোরে দেওয়া হয় টহল।
যদিও এখনও বহু বৈষ্ণব সাধক এই বৈশাখমাসের সন্ধ্যেবেলার নামগানকেও টহল বলেন। এই গানে থাকে না প্রভাতী আর্তি। তবে এই গানেও অন্তরআত্মার প্রতি আত্মনিবেদন থাকে, শিল্পী সাধক বা সাধক দলের। বাইরর জাগানো আর ভিতরের জাগানো, এই দুটিকেই টহল বলে।
বর্ধমানের কাটোয়া শহরে, সে সময় একটি শক্তিশালী বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। তার ঠিক পরে পরেই বাঘনাপাড়া ও কালনাতে বৈষ্ণবধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। হুগলি জেলার কাছাকাছি দক্ষিণ পূর্ব বর্ধমানে শৈবধর্ম জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন লোকধর্মও প্রচলিত ছিল, রমরমিয়ে। শৈবধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শাক্তধর্ম যেমন ছিল, তেমনই জনপ্রিয় ছিল ইসলাম ধর্মও। চৈতন্যের জীবনীকার এবং বৈষ্ণবধর্মের ধারায় অন্যান্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা করার কথা বলা হয়েছে।
যদিও সুপ্ত ভাবে হলেও বৈষ্ণবদের তিনটি ধারার মধ্যেই রয়েছে বিরোধ। কোথাও কোথাও সেই বিরোধ রক্তিম হয়েও উঠেছে। তবুও প্রকৃত গৃহী বৈষ্ণবরা আজও অহিংসর কথা বলেন। তৃণের মতো ধৈর্য ও সহ্যের কথা বলে।
কোথাও কোথাও শাক্ত ও বৈষ্ণবের মধ্যেও রয়েছে বিরোধ। তবে এসবের উদ্ধে, বৈষ্ণবদের সাধনসংগীত টহল।
সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আজও টহল গানের চর্চাক্ষেত্রে রয়েছে। সেখানে শিক্ষিত, অশিক্ষিত বলে কিছু নেই। মনের বৈরাগ্য এলেই একজন সামাজিক বৃত্তশালী মানুষও নেমেছেন টহল দিতে।
হেমন্তের ভোরের, সেই টহলগান গান একে অপরের আত্মজাগরণের পথকে করেছে সুগম। যুগ যুগ ধরে বাংলার বৈষ্ণবীয় সাধক সমাজ সেই পথ ধরেই এগিয়েছে। সেখানে কণ্ঠের রেওয়াজে মিলিত হয়েছে চৈতন্য, রাগাত্মিক, রাধাভাব, কৃষ্ণবন্দনার পাশাপাশি প্রভাতি সুরে নগরকীর্তনের নামগান। এই সব পেড়িয়ে ভক্তিধর্মের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে টহল এসেছে এগিয়ে। গুরু পুজোকে
কেন্দ্র করে একদা যে বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে ফাটল ধরেছিল, আ চণ্ডালের মধ্যে প্রেম বিলীয়ে টহলই সেই বৈষ্ণবদের একত্রিত করছে, সে যুগের রাঢ় বাংলায়।
Monday 25 May 2020
এই অন্ধকার সময়ে গণস্বাস্থ্য ও স্থায়ী চাষবাসের দিকেই নজর দিতে হবে আমাদের!
রাধামাধব মণ্ডল
বড়ো অন্ধকার সময়! আলোও রয়েছে দূরে দাঁড়িয়ে! ক্রমশ অন্ধকার ঘিরে ফেলছে আমাদের! দূরে দাঁড়ানো আলো, কখন কাছে এসে আমাদের পাশে দাঁড়াবে, কেউ জানি না! মনের মধ্যে একটি ঝড় তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে একটানা! সমবেত উদ্যোগেই একদিন ঝড় কাটলে, আমরা যেন আশ্রয়হীন মাঠে না দাঁড়ায় ; তার উদ্যোগ নিতে হবে এখুনি! সেই উদ্যোগেই বাঁচবে আগামী! এই সময়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গুলোর অন্যতম হলো স্বাস্থ্য! গণস্বাস্থ্যকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি!
বিনা নজরে পড়ে রয়েছে বাংলার সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র গুলো, গ্রামে গ্রামে! সে গুলোর উপর কোনো নজরদারি নেই, নেই চাঙ্গা করার মতো বিকল্প কোনো উদ্যোগও! বাংলা জুড়ে গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এবার সঙ্কট শুরু হয়েছে! করোনা কালে ও তার পরবর্তী সময়ে বাংলার মানুষ এর জন্য ভুগবে! বামফ্রন্ট সরকারের মাঝখানের সময়েই আচমকা পঞ্চায়েত এলাকায় একটা করে গড়ে তোলা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলো এখন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে ছিল ১০ টি করে বেড পরিসেবা, সঙ্গে সঙ্গে চলতো সর্বক্ষণের জরুরি পরিসেবাও। গ্রামীণ বাংলায় বর্ষাকালে সাপের কামড়ের ভ্যাকসিন, কুকুরের কামড়ের ভ্যাকসিন ছাড়াও নানা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায়, এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ২৪ ঘণ্টার পরিসেবা ছিল বাংলার নিরন্ন মানুষের কাছে বেঁচে থাকার আশ্রয়। আজ সেই আশ্রয় সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে! ২৪ ঘণ্টা দূরে থাক, বেশির ভাগ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই আর খোলা হয় না! দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি সেই সব প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমি! নেই নার্স, নেই ডাক্তার! কোথাও কোথাও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভগ্ন ঘরে চলছে জুয়া, নেশার আড্ডা! পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট, বীরভূমের পাঁড়ুই থানা এলাকার এমন কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের গায়ে লেগেছে, সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘরের তকমা! এই কঠিন সময়ে সেই সব স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলি স্বচল থাকলে, বদলে যেতে গ্রামীণ বাংলার চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্রটাই! করোনা কালে তারাও লাগতো সাধারণ চিকিৎসার কাজে!
এই প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাথার উপর প্রতি ব্লকে এখনও টিমটিম করে জ্বলছে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলো! কম বেশি এই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এখনও চিকিৎসা পদ্ধতি জারি রয়েছে! তবে সেখানেও পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট স্টাপ, এনএস নেই! তাই মাঝে মাঝেই অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ আসে সেই সব স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে। গ্রাম বাংলার কোনো ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেই, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ! অথচ এই দুই ডাক্তারদেরই মেডিসিনের পর বেশি প্রয়োজনে লাগে মানুষের! বামফ্রন্টের ক্ষমতার মাঝামাঝি সময়ে থেকেই এক প্রকার সর্বক্ষণ খুলে রাখা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তেমনই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোও পড়েছিল মুখ থুবড়ে! একপ্রকার পরিকাঠামো ছাড়ায় চিকিৎসা করতে হয় ডাক্তার বাবুদের। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার, রোগীর চাপ দিন দিন বাড়ছে। নেই পরিকাঠামো, নেই তেমন ঔষুধও!সবথেকে বড়ো বেশি বিপদজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এক শ্রেণির ডাক্তাররা এই সব ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্তা বিএমওএইচ হয়ে এসে! তাদের দেখ ভালের জন্য কোনো কমিটি নেই। থাকলেও জেলা সিএম ওএইচ এই সব ডাক্তাদের উপর তেমন নজর দেয় না! ফলে বহু বিএমওএইচ মর্জিমাফিক ডিউটি করে! লক্ষ্যও রাখে না হাসপাতালের! সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বে থাকলেও, সেই সময়ে তিনি প্রাইভেট প্যাক্টিস নিয়ে ব্যস্ত! সেই সব নানা কারণে এমনিতেই ধুঁকছে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গুলিও! অন্য দিকে এই সব কারণেই জেলা সদরের মহকুমা, কিংবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুলোতে দিন দিন বাড়ছে রোগীর চাপ! ফলে চিকিৎসা পরিসেবার মান গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে! এই ধারার বদল আনা জরুরি!
এই কঠিন পরিস্থিতিকে সামলে, করোনা পরবর্তী ভারতবর্ষের মানচিত্রে অর্থনৈতিক গাড্ডায় ফেলা থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে একমাত্র কৃষকরাই! স্থায়ী ফার্মা কালচারের দিকে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। পতিত জমিতে সবুজ ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে কৃষকদের হাত ধরেই! সেই সঙ্গে সরকারি পতিত, খাস, অসমতল জমিকে, ধাপ সৃষ্টি করে, সরকারি সংরক্ষণ করা জমিতে, বনভূমিতে ফলমূলের পাশাপাশি দেশজ চাষবাসের সুযোগ তৈরিতে জোর দিতে হবে, সরকারি উদ্যোগে নামাতে হবে চাষিদের! এক একটি গ্রাম, বা শহরের দত্তক দিতে হবে এলাকা চিহ্নিত করে কৃষকদের হাতেই! তারাই সেই এলাকায় এলাকায় করবে খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ! তাহলেই খাদ্য সঙ্কট ঠেকাতে পারা সম্ভব হবে!
এবছর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কৃষকের সামনে বড়ো বিপদ! বোর ধানের পাশাপাশি, মাঝে মাঝেই শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে আনাজপাতির! ঘনঘন স্বপ্নের মৃত্যু হচ্ছে কৃষকের ঘরে! শূন্য মাঠে থৈথৈ করছে অসময়ের জল! ফলে ঠিক সময়ে ফলছে না ফসল! করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি, এই লক ডাউনের কারণে কিছু কিছু জায়গায় নতুন করে খাদ্য সঙ্কটেও পড়বে মানুষ! সেই সঙ্কট ঠেকাতে এখুনি রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। সময়ে বাংলার কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হোক শষ্য বীজ! ১০০ দিনের কাজের রূপায়ণ হোক, কৃষিক্ষেত্রে! অজয়, দামোদর, পদ্মা পাড়ের বহু কৃষি জমিতে দীর্ঘ দিন বন্যায় নদীর বালি পড়ে রয়েছে! নষ্ট হয়েছে কৃষি জমি! সরকারি পদক্ষেপ করে, ১০০ দিনের কাজে সেই সব জমিতে বালি তুলে ফেললে, সেই জমিতে নতুন করে সবুজ ফসল উৎপাদন করতে পারে কৃষকরা!
এই মুহূর্তে গণস্বাস্থ্য ও স্থায়ী চাষবাসই বাঁচাতে পারে একমাত্র এই বিপন্ন বাংলাকে! এবং আমার দেশকে! সরকারি উদ্যোগে এই দুটি ক্ষেত্রে কিছু পরিকল্পিত পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে! বাংলার ইতিহাসকে ধরে রাখতে, এখুনি আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ কৃষিতে ও গণচিকিৎসায়! তবেই একের বাংলা, দশের ভারত হয়ে উঠবে!
সেলফি-র ছবি বদলে দিচ্ছে করোনা! আরও কিছু বদল আসবেই...!
রাধামাধব মণ্ডল
ভারতবর্ষ জুড়ে বদলে যাবে সেলফি-র ছবি! এখন বদলাতে শুরু করেছে জটিলের ভাষাও! মৃত্যুকে কে না ভয় খায়! কে না চেনে মৃত্যুর পরের শূন্যতা! জীবিতরা একটি মৃত্যুকে ভুলতেও নেয়-না সময়! সেটাই ভাবাচ্ছে স্বেচ্ছাচারীদের! নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো প্রয়োগ করতে শুরু করেও ব্যর্থ হচ্ছে একদল চতুর! তাদেরও ভাবাচ্ছে মৃত্যু! বার দরজা খোলা, পেড়িয়ে এসে ক্রমশ শিহরে শাসাচ্ছে মৃত্যু! কে যায়, কে আসে এই প্রেমহীন পৃথিবীতে! প্রতিদিন করোনা ও অন্যান্য নানা কারণে আমাদের মাটির পৃথিবী ছেড়ে একদল নির্বাচিত মানুষ চলে যাচ্ছেন! আরও অনেকে যাবেন! নিশ্চিত সেখানে আমি বা আমার পরিচিতরাও কেউ কেউ থাকবেন! মানব সভ্যতা এমন করে সঙ্কটের মুখোমুখি হবে, কে তা জানতো! এই অনুমান কি করেছিলেন বরেণ্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং! এবার কি তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হতে চলেছে! কোনো নির্বাচিত যুক্তির উত্তর নেই আমাদের হাতে! সংবাদ মাধ্যম আমাদের গিনিপিগ করছে, ব্যবসায়িক কারণে! একে একে নিভছে দেউলটি! ওপাড় থেকে কার কখন ডাক আসবে কেউ জানি না! এ-র মাঝেই ঠেলাঠেলি করছি, নিজেরা! দেশের ভূখণ্ড নিয়ে নেমেছি হিংসার খেলায়! দূরে বাতিঘরে একজন পুরুষ দেখছেন এক বৃহত্তর নারীকে, যিনি ধরে রেখেছেন এই আলোময় আলোচনার জগৎ! তুমি, আমি দর্শক মাত্র!
অনেকে আজ জেনে গেছেন, জাতীয় অধ্যাপক, লেখক ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যু করোনায় হয়েছে। শব্দ সাধক, অক্ষরচিত্রী দেবেশ রায়ের মৃত্যুও করোনার বাইরে নয়! আরও অনেকে চলে গেলেন, চলে যাবেন করোনার ভয়াবহ আক্রমণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু স্পষ্ট করেই বলেছে, করোনাকে হয়তো কোনও দিনই নির্মূল করা সম্ভব হবে না। করোনাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে আমাদের! মৃত্যুর আগে স্টিফেন হকিং যে-আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, করোনার হাত ধরে মানববিশ্ব কি তাহলে সেই বিনাশযুগের দিকেই হাঁটছে! সংক্রমণে অন্য অনেক ভাইরাসের চেয়ে করোনা অনেক দ্রত ছড়াচ্ছে। ভয় তো সেখানেই! লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই আক্রান্ত থেকে অনাক্রান্ত মানবশরীরে এসে ঢুকেছে এই অনুজীব।
এ-ই প্রশ্ন গুলোই ঘুরছে, চিন্তার জগতের দখলদারি নিয়ে! ফলে একটু সচেতন মানুষ টিভির থেকে দূরে থাকছেন! ফেসবুক পোস্ট, হোয়াটসঅ্যাপ দেখুন সেখানেও ঘুরছে ভারতবর্ষের রাস্তার ছবি! সে ছবি ভয়ংকর, ভয়াবহ! আমাদের থামিয়ে দিয়েছে! রাস্ট্রের অব্যবস্থার কারণে, পরিকল্পনাহীন একদল নিরন্ন হতদরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষ শুখনো রুটির স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে মর্মান্তিক শান্ত দিশাহীন অন্ধকারের ভিতরে হাঁটছেন! সেই পথেই তারা কেউ কেউ পৌঁছে যাচ্ছেন, না ফেরার দেশে! অথচ চৌকিদার সব দেখে ছবি আঁকছেন করোনা পরবর্তী সমাজের উন্নয়ন নিয়ে! সেই উন্নয়ন চালু রাখতে ট্রেন, বাস, প্লেন চলাচলের ব্যবস্থা হলেও, সেই ভারতবর্ষের মা এখনও রাজপথে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছেন, ঘুমন্ত বুকের শিশুকে টলি ব্যগে শুইয়ে রেখে, টানতে টানতে!
৭৬ এর মন্বন্তরে আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখেছি, সেই খাদ্য সঙ্কটের ছবি! ক্ষুদার্থ মা তার বুকের সন্তানকে মাটিতে ফেলে, তার উপর দাঁড়িয়ে গাছের পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে! আজও তেমন ছবি দেখার দিন শুরু হবে না তো! বড়ো ভয় হচ্ছে, এমন ভারতবর্ষকে কখনো দেখিনি আমি! যেখানে আজও ভাতের জন্য, অপেক্ষা করতে গিয়ে অনন্ত নিবিড় মৃত্যুকে বরণ করে হাজার হাজার মানুষ!
আগামীকাল যে আরও অনেক সমবেত স্বপ্নের মৃত্যু হবে আমাদের, সে নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই! তবে পরিচিত পৃথিবীর মৃত্যু হলে, অপরিচিত আঁধার পৃথিবী আমার জন্য নয়! প্রয়োজন হলে আরও একটা বিপর্যয় আসুক, আলো আঁধারের দূরত্ব মুছতে!
রাধামাধব মণ্ডল
শুধু মন নয়, শরীরের ভাবও প্রকাশ করে "কথা"। আর কথা'র লিখিত রূপই ভাষা। বাঙালির বলা কথা, মার্জিত লিখিত রূপ বাংলা ভাষা বলা যেতে পারে! আর কথায় আমাদের সম্পদ। মন ও শরীরের যৌথ পারফর্মেন্স আর্ট কথা! জীবনের সমবেত গ্যালারিতে কথা-ই একমাত্র আকর্ষণ বন্ধনের, বন্ধুত্বের! উদ্দেশ্য সকলে মিলে একটি সুস্থ সমাজের মধ্যে থাকা! কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে স্তোস্ত্রগীত রচিত হয়েছে " কথা" র মায়াজালেই!
খুনির কথা, বিচারকের কথা, এক নয়! আবার বিচারের জন্য যে পদ্ধতি সেখানেও, কথার মারপ্যাঁচের যুক্তি তর্কের মধ্যে মেধার লড়াইয়েই হয়! এতো সবের মধ্যেও বাঙালির এই "কথার" চর্চার ধারায় এবার পরিবর্তন আসা জরুরি! তা না হলে তর্কপ্রিয় বাঙালি এবার, জগৎ সভায় যাবার আগেই হারবে! তাই এই মুহূর্তে বাংলার মানুষের কথার বিবর্তন দরকার জরুরি! বিভিন্ন কথায়, এমনি থেকেই কথার টানেই নতুন কথারা এসে গোলমাল পাকিয়ে তৈরি হচ্ছে মনের দূরত্ব! আর এই মনের দূরত্ব ঘনীভূত হতে হতেই নানা রকমের হিংসার মায়াজালে জড়িয়ে ফেলে জীবনকে! সে জীবনে যেমন থাকে না তখন সুস্থতা, তেমনই সে নিজের অস্থিরতা লুকিয়ে রাখতে না পেরে আর এক সুস্থ জীবনকে আঘাত করে ফেলে! বাড়তেই থাকে আঘাত! এই ভাবেই কথার ফুপি হারিয়ে গেলে, আলগা কথার মিথ্যা চারিত্র্যই প্রকট হয়ে গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়িয়ে ফেলে সমাজে! তখনই শুরু হয় দিন দিন নানা আক্রান্ত, আর এই আক্রান্ত হওয়ার খবর আরও কিছু মানুষকে আক্রান্ত করে, অসুস্থ করে, অন্ধকারের ভিতরে নিয়ে চলে উদ্দেশ্যহীন!
ভাঙা, মেদবহুল কথার জরিপের নিত্য নতুন টানেই এলাকার পরিধি বাড়িয়ে নেয়, সে তার নিজের গুণে! ফলে সেই অসুস্থতার চিকিৎসা করা মুসকিল! অসুস্থ কথার চিকিৎসা, একমাত্র আপনিই করতে পারেন। নিজের পরিবর্তন আর অভ্যাস পাল্টে ফেলে! তেমন সমাজতত্ত্বিক, তেমন মনোবিদদের পরামর্শ নিতেও তখন মনের আনন্দ-আয়োজন থাকে না! জটিল অন্তশাসনে বাংলাদেশের সুবর্ণময়, নির্মল নিষ্পাপ ধার্মিক প্রাচীন পরিবেশটি শুরু করে করেছে হারাতে! তাকে ফিরিয়ে আনার যোগ্য উত্তরাধিকার অভিজ্ঞতা, তখন আর কী থাকবে টিকে!
করোনা পরিস্থিতিতে একটি সরকারি শব্দবন্ধ বাংলায় শুধু নয়, গোটা দেশের মানুষের কাছে ঘুরছে। সেটি হলো "সোশাল ডিস্টেন্স", আমার মনে হয়েছে এই শব্দবন্ধটি না ব্যবহার করে " ফিজিক্যাল ডিস্টেন্স" হওয়া উচিত! এমনই কিছু শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, আমরা বাঙালিরা বড়ো অসচেতন হয়ে পড়েছি।
সেই বৈদিক যুগে ভাষা ব্যবহারের লালিত্য ছিল, তার অনুমান মেলে প্রাচীন সাহিত্যের ধারায়। এখনকার চটকদার কথা, বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম, চাঞ্চল্যকর প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে ভাষার কথ্যরূপ! ভাষায় আনা হচ্ছে কিছু অন্ধকার দেশি-বিদেশি শব্দ। এতেই বিষ্ময়কর লাগছে ভারের, গর্বের এই বাংলা ভাষার প্রকাশ রূপ কথাই । এমন আলগা কথার স্রোত ভাসছে বাংলাতে!
আধুনিক সিনেমার চিত্রনাট্যের রসায়ন, যেন মিলে যাচ্ছে সমাজিক ভাষা ব্যবহারের বিজ্ঞানের সঙ্গেও। ফলে ক্রমশ প্রাঞ্জল ভাষার "ধ্বনির " কথ্যরূপে এসে থেমেছে অশ্লীলতা কথায়! স্বল্পবসনা হাস্যোজ্জ্বল করেছে, চিন্তাশীল বিচক্ষণ বাঙালিকে! আর কবে নড়বে বাঙালি! কবে জাগবে বাঙালির মনে, কবে আবার একত্রিত হয়ে চিন্তাশীল বিচক্ষণ বাঙালির মুখে ফুটবে প্রাঞ্জল প্রাচীন মিষ্টি বাংলার সুরেলা মধুবাক্যের স্রোত, কথার স্রোত ! সেই কথার বিবর্তনের পথ চেয়ে রয়েছে, আগামী সমাজ! যেখানে জোর করে আধুনিক রসায়নের পোশাক পড়ে বাঙালি আর দাঁড়াবে না! বাঙালির যুক্তি তর্কের মেধার লড়াইয়ে আবার নতুন ভাষা ধ্বনিত হবে কথায়! সে দিনের অপেক্ষায় থাকবো আমরা, গুটিকয়েক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা বাঙালি!
আর সেই মগজের খাদ্য ভাষায় আবার আগামীর বাঙালিকে আবার বিশ্বসেরার দরবারে স্থান করে দেবে, এ বিশ্বাস থাকুক! আড্ডার বাঙালি কথা, দীর্ঘ জীবী হোক! পাড়ার ঠেক দীর্ঘ জীবী হোক! পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই জন্ম নিক নতুন কথারা! সমবেত কথার স্রোত বইয়ে চলুক বাঙালির মনের মননে!
Wednesday 1 April 2020
http://www.sukhabar.in/
নিভৃতপুরের গানওয়ালা রতন কাহার
রাধামাধব মণ্ডল
"বড়লোকের বিটি লো / লম্বা লম্বা চুল;
এমন মাথা বিন্ধে দিব / লাল গেন্দা ফুল৷"
নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সে আজও কাঁচা শীতের ভোরে মানুষটি হাঁটেন সিউড়ির পথে পথে। তিনি বাংলার প্রাচীন সাধন সংগীত টহলকে এখনও নিজের ভাষায় গান। জীবনের উপান্তে পৌঁছে মানুষটি হেমন্তের শীত কাতুরে ভোরবেলা গান গেয়ে ফেরেন ভাঙাচোরা গলায়। আজও এই অঞ্চলে তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন বাংলার হারাতে বসা প্রভাতী সাধন সংগীত টহলকে। একক পথ পরিক্রমা করে তিনি পথে পথে এগান গেয়ে ফেরেন, শুধু জীবিকার টানেই নয়। এই টহল গানের মাধ্যমেই তাঁর খ্যাত এবং গলার রেওয়াজ করা।
"কালো কি ছুঁলে কালো হয়/ওহে রাই তোমারে শুধাই।/পদ্মপুষ্প হয় না কালো, ভ্রমর বসে মধুখায়/ আমায় ছুঁলে হবে কালো জেনেছো কি রাই কিশোরী /শীঘ্র করে খুলে ফেল পরণের ওই নীল শাড়ি।"
বাংলার পথে পথে, রাঙা ধূলোয় খঞ্জনি বাজিয়ে কীর্তন করা এমাটির অতি প্রাচীন এক সংস্কৃতি। কার্তিকের শুরুর দিন থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত নগরের পথে পথে এগান আজও গাওয়া হয়। এই ধারা ধরে রেখেছেন বীরভূমের এই নগর কীর্তনীয়া।
এই সাধন সংগীত নিয়ে বলতে গিয়ে স্মৃতিমেদুর শিল্পী বলে উঠেন, ‘ছোটবেলায় অন্ধ নেপাল দাসের কাছে টহলের কয়েকটা পদ শুনেছি। আজও সেই গাই ভোরবেলায়।"
তিনি নিজেও প্রভাতী সাধন সংগীত টহল গান বেঁধেছেন।
রতন গানওয়ালা প্রায় দু’হাজার গান লিখেছেন।
সিউড়ি শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের নগরী গাঁয়ের লম্বা মাটির উঠোন! তারই মাঝখানে দোচালা মাটির ঘর! সেখানেই চাঁদপানা ছোট্ট মেয়েটার একঢাল চুলে লাল ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে নিজের ট্র্যাজিক জীবনের কাহিনি তরুণ লোকশিল্পীকে শুনিয়েছিলেন কুমারী মা। পতিতা মায়ের গল্প। তন্ময় হয়ে সে গল্প শুনছিলেন শিল্পী। পিতৃপরিচয়হীন নিজের একরত্তি মেয়েটা সম্পর্কে কথায় কথায় বলেছিলেন কুমারী মা, ‘এই যে এত্ত চাঁদ রূপ মেয়ের, হবে না-ই বা কেনে? জানিসই বড়লোকের বিটি আছে বটে’। মা চেনে বাবার পরিচয়! এই গল্প থেকেই জন্মায় কালজয়ী সেই গান, ‘বড়লোকের বিটি লো’। ১৯৭২ সাল সেটা, তারও আগে হতে পারে। সে দিনের সেই তরুণ শিল্পী রতন কাহার এখন অশীতিপর। তিনি এই গল্প শোনার পর বেঁধেছিলেন গান! বসিয়েছিলেন নিজের মতো করে মাটির সুর! রজত কুমার সাহার মাধ্যমে, রতন কাহারের থেকে খাতা নিয়ে তিনটি গান গাইবার জন্য নেন স্বপ্না চক্রবর্তী।
১৯৭৬ সালে গানটির রেকর্ডিং করেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ তারপর সেই গান অশোকা রেকর্ড কোম্পানির দৌলতে লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে৷ জেতে গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কারও৷ এখনও একই রকম জনপ্রিয় গানটির স্রষ্টা রতন শুরুটা করেছিলেন আলকাপ দিয়ে। যাত্রার দলে ডাগরআঁখির ‘ছুকরি ’ সাজতেন৷ সং সাজতেন। তাতে দু'চার টাকা পেতেন। পরে তিনি নিজের উদ্যোগে তৈরি করেন ভাদু গানের দল৷ বেঁধেছেন অজস্র ঝুমুর গান৷ নেচে নেচে সে সব গেয়েছেনও। পুরস্কার, শংসাপত্র এত পেয়েছেন, যে একচিলতের ঘরে আর তা রাখার জায়গা নেই৷ এসব দিলে, মনে আনন্দও হয় না আর! এখন টাকা পেলে ছেলেদের হাত তুলে দেন, তাতেই বেজায় খুশি হয় গানওয়ালা রতন। সরস্বতীর বরপুত্রর লক্ষ্মীলাভ হওয়া সহজ কথা নয় কোনদিনই৷ এই গান ব্যস্ত মানুষটাই একদিন গান ছেড়ে দেওয়ার পথ ধরেন। চলে আসতে চান গানের পথ ছেড়ে! সাংসারিক তীব্র অনটনের কারণে এমনই স্থির করে জীবিকার প্রয়োজনে হাঁটতে শুরু করেন শ্রমের পথে! একসময় নিরন্তর দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় গান বাঁধা৷ তবে কি তাতে মন টেকে? সেই সঙ্কট কাটিয়েও ওঠেন একসময় রতন কাহার! তবে এই গানপাগল মানুষটার খ্যাতি জোটেনি তেমন, তবে মানুষের মনের কুলঙ্গিতে ঠাঁই পেয়েছে তাঁর সুর৷ বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম
বাসিন্দা মানুষটা বিড়ি বেঁধে, খেতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন৷ অভাব অনটন নিত্যসঙ্গী জীবনভর আর তাকে সঙ্গে নিয়েই মহানন্দে হেঁটে চলেছেন লালমাটির পথে।
তিন ছেলে এক মেয়ের কেউই মাধ্যমিকের গন্ডি টপকাতে পারেনি পয়সার অভাবে৷ মেয়েটা ভালো গান গায়, কিন্তু একটা হারমোনিয়ামও কিনে দিতে পারেনি অসহায় বাবা রতন কাহার৷ মেয়েও বাবাকে নিয়েছে নিজের মতো।
এখন আর বিড়ি বাঁধার ক্ষমতা তেমন নেই৷ গানওয়ালা পারে না অন্য কাজও করতে! এখন সম্বল সরকারি ভাতা এবং অনুষ্ঠান করে পাওয়া, ওই ক'টা টাকা! ভেঙেছে শরীরের দেওয়াল! কৃষ্ণ কালো মাটির উপর দাঁড়িয়ে দুই চোখের কিনারে চলকে ভেসে আসে এক উজ্জ্বল আলো! তাতেই গিয়েছেন নিজের নৌকায় বিস্মৃতির আড়ালে৷ কে আর কদর করে তাঁর!
লোক সংগীতের রসিক লোক ছাড়া, আর সকলেই তাঁকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে!
সেই কুমারী মা নিজের জীবনের সব গল্প বলেছিল রতনকে৷ ওঁর জীবনের আশ্রয়দাত্রী ছিল হরিদাসী৷ সেই প্রৌঢ়ার একটা ঝুমুরের দল ছিল৷ ওঁর কাছে থেকেই সুর নিতে গিয়ে তখনই আলাপ৷ সেই তরুণীর গল্পে এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন, যে গানটা লেখার সময় ওই গল্পটাই মাথায় ঘুরছিল রতন কাহারের৷ ইশারায়-ইঙ্গিতে সেই মেয়েকে বাবুর বাগানে দেখা করতে বলত তার প্রেমিকটি৷ অল্প বয়সে না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে মেয়ে৷ যখন টের পায় শরীরে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে, তখন পিতৃত্ব অস্বীকার করে প্রেমিক৷ সে তো তথাকথিত বড় ঘরের৷ শুরু হয় জীবনের টানাপোড়েনের লড়াই। তাই তার ঔরসে জন্মানো নিষ্পাপ শিশুটিকে উদ্দেশ্য করেই তৈরি হয় "বড়লোকের বিটি লো" গানটি।
একসময় চুটিয়ে কাজ করেছেন আকাশবাণীতে৷ পাহাড়ি সান্যালই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভালোবাসার আকাশবাণীতে। সেই কলকাতার শহর চেবা! দূরদর্শনেও করেছেন নিয়মিত কাজ! দুই মাধ্যমেই নিয়মিত কাজ করেছেন তখন, একটানা বেশ কয়েক বছর। অভিমান জড়ানো গলায় বলেন, ‘আমাকে নিয়ে অনেকেই ব্যবসা করেছেন৷ আমার লেখা , আমার বাঁধা গান নিয়ে এসে রেকর্ড করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন৷ সবাই আশ্বাস দেন৷ কিন্তু কিছুই হয় না৷" আবার মুহূর্তেই অবশ্য অভিমান গায়েব হয়ে শিশুসুলভ সারল্য ঝরে পড়ে উনার কণ্ঠে, ‘ওঁরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ মলয় বিকাশ পাহাড়ি, আর্য চৌধুরী, আনন গোষ্ঠীর রাজকুমার সাহারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন আমার সঙ্গে৷ আনন গোষ্ঠীর সঙ্গেই এসে খাতায় বড়লোকের বিটি লো গানটা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ তবে তিনি রেকর্ড করার আগেই আমি গানটা গেয়েছিলাম রেডিয়োতে।
পূর্ণচন্দ্র দাস বাউলও গেয়েছেন আমার গান, ভাঙা গলায় বললেন তিনি। তিনি আরও বললেন, আমার এই গান গুলি কিশোরী (দাশের) বাবুর "চন্দ্রভাগা" পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল। আরও বহু কাগজে হয়েছে ছাপা!
যাঁরা চিনেছেন -বুঝেছেন , তাঁরা কাজ দিয়েছেন রতন কে৷ তবে সময়ের দুর্বার স্রোতে ধীরে ধীরে কাজ কমতে শুরু করে রতনের জীবন থেকে৷ কেন্দ্রের পলিসিতে প্রসার ভারতী তার অনুষ্ঠানটা বন্ধ করে দেয় একসময়। পুরোনো মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অন্য জায়গায় চলে গেল বদলি হয়ে৷ আর তখন থেকেই রতন কাহারের জীবনে শুরু হয় আপাত অন্ধকারের ভাঁটা। থেমে যায় স্বাভাবিক ছন্দ। রতনের চিরকালের পছন্দের গান মাটির গান। আজও তাই ঝুমুর -ভাদুতেই ডুবে রয়েছেন তিনি৷ এখনও বাঁধছেন নতুন নতুন গান। নতুন প্রজন্ম খোঁজ নেয় না তেমন! তবে কেউ কেউ তাঁর কাছে আসেন আবেগ নিয়ে!
শিলাজিতের জন্য ভাদু গান লিখেছিলেন তিনি৷ এই সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী শিলাজিৎ হাজার তিনেক টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন রতন কাহারের হাতে৷ তাতে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর কলেজে অনুষ্ঠান করে খুব প্রশংসা পান, সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে রতনের কথা শুনেছিলেন শিল্পী কালিকাপ্রসাদ৷ ২০১৭ মার্চে শেষ বার সিউড়ির অনুষ্ঠানে আসার পথে, রতন কাহারের বাড়িতে আসারও কথা ছিল! কিন্তু সে সময় দুর্ঘটনায় পড়ে তিনি চলে যান৷
রতন কাহার বেঁচে আছে গাঁয়ের মাটিতেই! এই ভাবনার মানুষের সংখ্যা বাড়লেও, রতন কাহার আজও মাটির গহীন অন্ধকার কোণে বসে বাঁধছেন নতুন নতুন গান। মাটি, মানুষের গান।
যে মানুষটা গান কে তার নিজের কন্যাসম মানতেন, গানের কথা সুর কাউকে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতেন, বদলে কেউ টাকা দিতে এলে বলতেন, "আমি বিটি বিচে টাকা লুবো না।" কেউ জানতেও চায় না আর সেই মানুষটার কথা...
"আমার গান শুনে যান ওগো বাবু, সুখেরই সংসারে /আমি এখন শুখনো পাতা, কখন যাবো পরে। "