Sunday 20 September 2020

 [01/08, 10:03] Radhamadhab Mondal: টহল ১৬


রাঢ়ের টহলে মিশেছে সহজের ভাব// 

রাঢ় বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি।

রাধামাধব মণ্ডল


রাঢ়ের টহলকে জাগিয়ে রেখেছে সহজভাব! একদিকে তার সঙ্গে যেমন মিশেছে প্রাচীন ধারা, ঠিক তেমনই মিশেছে তত্ত্বগত দিকটিও। আর এ-সবকে ছাপিয়ে, লোক গানের একটি রেশ গড়িয়ে গেছে টহলের ভিতরে। রাঢ়দেশীয় টহলের সংস্কৃতিতে মিশেছে ঝুমুর, ভাটির সুরও।


গোরা পদ কোকনদ

যার প্রাণ সম্পদ

মনে মনে স্মরি সে নিতাই;

যার হরি হুঙ্ক

গোরা এল নদীয়াতে

সে অদ্বৈতের বলিহারি যাই।

#

যার হরি কৃপা করি

ষড়ভূজ গৌরহরি

সে শ্রীবাসের নিতি গুণগাই ;

যারে লয়ে বাম পাশে

প্রেমরসে গোরা ভাসে

কান্তাভাব মাগি তার ঠাঁই।

#

যার হরিনাম শুনি

তুষ্ট গোরা গুণমণি

ভক্তি রত্ন মিলে যার কৃপায়;

শ্রীহরিদাসের দাস

এ রাধাময় করে আশ

নিত্য যেন গৌর সেবা পাই।


(দাস রাধাময় এর গান)


টহল শিল্পীদের গ্রাম বলতে রাঢ় বাংলার বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদীয়াই প্রধান। তবে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার একটি অংশে এবং হুগলী, মেদিনীপুর এলাকার পাশাপাশি দুই চব্বিশ পরগণা ও সেদিনের কলকাতা শহরে ছিল টহল শিল্পীরা। তাদের কোথাও টহল, কোথাও নামী, কোথাও হরিনামের দল, শিল্পী, সাধুসন্ন্যাসী বলেও আখ্যায়িত করা হয়।

সব থেকে বেশি টহল শিল্পীর বসবাস, দুই বর্ধমান, বীরভূমের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে নদীয়াতেও। নদীয়ার নদেরচাঁদ গৌরই তো এই জেলা গুলিতে কখনো নিজে, কখনোবা শিষ্যসন্তদের দ্বারা শচিমাতার নন্দনের ঘুম ভাঙানোর জন্য প্রভাতী সুরে আপ্তসাধন কথা গানের সুরে ভিজিয়েছেন। তারও কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে ছিলেন তিনি নিতাইকে নিয়ে। সেই বৈষ্ণবদের বৈজ্ঞানিক ধারাটি আজও চলে আসছে। তবে কালের স্রোতে, সময়ান্তরের ধারায় সেই ধারাটিতে ছেদ পরেছে বারে বারে। তবুও আজও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, ক্ষীণ সুরে হলেও বাজছে বাংলার প্রাচীন লোকায়ত সুরের এই সাধন কাকলি।

বাংলার এই ধারার লোকসংগীতের চর্চার সঙ্গে সাধক ও সাধনার বিষয়টি কি ভাবে যুক্ত হয়েছে, সে নিয়ে অস্পষ্ট হলেও নানা মুণির নানা মত রয়েছে। তবে কি সে সময়ের বাংলায় ধর্মভাবের প্রাবল্যজনিত কারণেই এই ধর্মীয় ভাবটি, আজকের হারাতে বসা লোকসংগীতের এই ধারার শরীরের সঙ্গে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে গেছে। অন্তজ শ্রেণিতে এখনও ঢোকানো যায়নি টহলকে।শ্রেণিগত ভাবে, টহল গানকে আজও চিহ্নিত করতে পারা সম্ভব হয়নি, যে টহল গান মূলত অন্তজ শ্রেণির সাধনগান। অতীতে কেবলমাত্র বৈষ্ণবেরাই টহল গান গাইতেন আর গান বাঁধতেন কেবলমাত্র বৈষ্ণব সাধকরাই। তবে বর্তমানে জীবন ও জীবিকার নানা টানাপোড়নে অনেকেই টহল গাইছেন। ডোম, বাউড়ি, বাগ্দী, ভল্লা, রুইদাস, গড়াই, সদগোপ, ব্রাহ্মণ থেকে সমস্ত জাতির উপার্জন কম মানুষেরা টহল গান করেন, জীবিকার্জনের জন্য। তেমনই পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অজয় তীরবর্তী রাজা অমরেন্দ্রর অমরপুরের মঙ্গলপুর গ্রামের প্রধান বসবাসকারী জাতি বাউড়ি সম্প্রদায়ভুক্ত মেটেরা, খেতের শ্রমিক  হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে বৈষ্ণবভাবে ভাবিত হয়ে তাদের অনেকে টহল গান করেন, কার্তিক মাসের ভোরে। সেই মঙ্গলপুর গ্রামে দীর্ঘ দিন ধরে টহল গান করে আসছেন ধংশো পরম্পরায় অমূল্ল মেটে, শ্রীধর মেটে, আনন্দ মেটে, মুরালী মেটে-রা। শুধুতাই নয় মঙ্গলপুর গ্রামের পাশেই অজয় নদ আর নদ পেরুলেই ইতিহাসের বাণিজ্য নগরী ইলামবাজার, সুখবাজার, একটু দূরে জনুবাজার, ভরাঙ্গী, টিকরবেতা, কেন্দুলী ও রামপুর। কয়েক বছর আগেও ইলামবাজার সুখ বাজারে টহল গান করতেন রাধা বৈষ্ণবী। তিনি এখন দেহ রেখেছেন। ইলামবাজারের লাগোয়া গ্রাম পায়ের, দেবীপুর, খয়েরবুনি। পায়ের গ্রামের প্রাচীন নাম পদচিহ্ন। কথিত আছে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য উৎকলদেশে যাওয়ার সময় এই পায়ের গ্রামে, পা রেখেছিলেন। তাই গ্রামনাম পদচিহ্ন থেকে পায়ের হয়েছে। সেই পায়ের গ্রামে রয়েছে মহাপ্রভু পার্ষদ কাশেশ্বর গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভু মূর্তি। তা আজও গোস্বামী বাড়িতে পুজিত হয়। গ্রামে রয়েছে বাউতি ভিটা। শোনা যায় পতিত সেই ভিটাতে একসময় বসবাস করতেন শ্রীখোল বাদক, জাগানোর গানের  সাধক রসরঞ্জন বাউতি। তিনি নাকি উৎকলযাত্রায় মহাপ্রভুর সঙ্গে শ্রীখোল বাজিয়ে, কীর্তনে নেচেছিলেন।

সেই গ্রাম গুলোতে এক সময় টহল গান গেয়ে মাধুকরী করতেন বিখ্যাত বাউল শম্ভু দাস। যিনি পরবর্তী কালে গৌর খ্যাপার সঙ্গে বাহাস গেয়ে, খমক লড়াইয়ে মাততেন! তাঁর পুত্র গৌর দাস বাউল ও তার বড়ো ভাই বিশ্বনাথ দাস এবং ছোট ভাই নিতাইরা এখনও টহল গানের চর্চা করেন।

বীরভূমের রাজনগরের শিক্ষক সন্তোষ কর্মকার বললেন, আমার ব্লকের রাজনগর, ভবানীপুর, তাঁতিপাড়াসহ কম বেশি সব গ্রামেই এখনও কার্তিক মাসের ভোরে টহল গান হয়। তবে নতুন প্রজন্মের তেমন সাড়া নেই এই লৌকিক সংস্কৃতির চর্চায়। এখনও এই অঞ্চলে পুরোনো দিনের বোষ্টমরাই ধরে রেখেছেন টহলের চর্চা। 

ইলামবাজার ব্লকের জয়দেব, সুগর, ভরাঙ্গী, জনুবাজার, রামপুর, বটচাতুরি, হাঁড়িপাড়া, বালারপুর, ভুবণেশ্বর, সন্তোষ পুর, টিকরবেতা ও শির্ষের মোড়াগাছি, উত্তরকোণা, খড়ুই, সুনমুণি, ঘুড়িষা, ধরমপুর, শালকা এই গ্রাম গুলোতে টহল গানের চর্চা রয়েছে, বললেন জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক রণজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি আরও জানান, জয়দেবের চার পাঁচটি গ্রামে টহল গান করেন নাড়ুগোপাল দাস, বাঁকাশ্যাম দাস, নিত্যানন্দ আশ্রমের অনিল মুখোপাধ্যায়রা। যদিও অনিলবাবু প্রাক্তন লাউদহা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তবুও তিনি এই লোকসংগীতের বিলুপ্ত ধারাকে নিয়ে চর্চা করেন। ধরমপুরে একটি আশ্রম আছে, যারা কালিদাস বাবাজির শিষ্য। তারাই শির্ষের গ্রাম গুলোতে টহল করে।

কবি প্রবীর দাস বললেন, ছোট বেলায় আমার জন্মগ্রাম নানুরের জুবুটিয়াতে কার্তিক মাসের প্রতিটি ভোরে, বৈরাগীরা টহল দিতো। পরের এপ্রজন্মের আনন্দ বাগ্দী এবং বি কম পাশ করা শিক্ষিত যুবক প্রভাত গড়াইও (কানাই) প্রতিদিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, কার্তিক মাস ধরে টহল গাইতো।

টহল গানের মূল উপজীব্য বিষয় বৈষ্ণব সাধনতত্ত্ব কে নিয়ে, গান গাওয়া। এই গানে বৈষ্ণব তত্ত্ব প্রসঙ্গ  একবার যদি আসে, তাহলে তা আর যেন শেষ হতেই চাই না। সাধকরা বলেছেন, তত্ত্বও যে আপেক্ষিক, সেটা ভুললে হবে না। যেমন দেখতে হবে গৌড়বঙ্গে প্রচলিত বৈষ্ণবধর্মের আসল কেন্দ্রবিন্দু এখনও মানুষ। বৈষ্ণবী তত্ত্বে এই মানুষকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। ঠিক তখনই সমাজ, সংসারে ধর্মের গতিপ্রকৃতি ও তার তাৎপর্য নির্ণয় গৌণ হয়ে পড়ে।

সেই আদিকাল থেকে বৈষ্ণবদের ধর্মের কিছু গৌণ ধারা ছিল। কয়েকটি এখনও টিকে আছে। তেমনই একটি গৌণ ধারার বাহ্যিক রূপের প্রকাশ গীতই হল টহল। মনের আমিকে জাগানোর গান।

চিন্তার চিন্তনে সেই অস্তিত্বের আমিকে আহ্বান করা হয়, এই টহল গান দিয়ে। এই গুপ্ত গৌণ ধারার চর্চাক্ষেত্র এখনও বাংলার বহুগ্রাম। 

 পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অমরপুরের ভোগাতলা, গোঁসাই বাগান, কালিকাপুর, মৌখিড়া গ্রামের টহল শিল্পী আকুলিয়া গ্রামের শিবু ঠাকুর। তিনিও তত্ত্ব কথার আগম রস জানেন। বীজের সাধনকথা তুলে আনেন গানের পদে।

একটি পরজীবী দেহকে নিয়েই অস্তিত্বের সাধনা করেন টহল শিল্পীরা। তবে এ সাধনায় প্রাণের অস্তিত্বের প্রকাশ ও বিকাশ রাখা জরুরি। 

সামাজিক নানা খসড়াতে দেখা যায়, একটি পরজীবী শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ চলার পথে! এবার তাদের বড়ো দু'দিন আসছে! টাকার দামতো আর থাকবে না! এই সঙ্কটকালে থাকবে না সাহিত্য, সংস্কৃতি, আভিজাত্য, আধিপত্যের দামও! শুধু ভাতের দাম হবে এবার! ভাতের জন্য আবার একবার গোটা মানব সভ্যতা বাঁচতে শুরু করবে শত্রুতা! 

বিদ্বেষ জাগরিত হবে, এবার কেবল ভাতের টানেই! সেই সঙ্কট কাল থেকে পথ দেখাতে বৈষ্ণবেরা প্রচার করছেন গৃহের সাধনা। গৃহের আপ্তসাধন গুণই আগামীকে পথ দেখাবে। তার একটি স্বচ্ছ ধারাকে, আবার জাগিয়ে তুলতে গৃহী সাধকদের বান আসা দরকার। তাই এই সঙ্কটের সময়ে প্রাচীন বৈষ্ণবীয় মহাজনরাই দেখাবেন পথ।

তাল তমালের শান্ত সমাহিত ছায়ায় অজয়ের তীর। ছোট ছোট প্রাচীন আখড়া, আশ্রমের সারি। অদূরে কদমখণ্ডী ঘাটে নশ্বরদেহ পুড়ছে! পঞ্চভূতে বিলীন হচ্ছে বর্তমান। আগামী ডেকে আনছে ভাববাদকে। তার পিছুপিছু আসছে সাধক বৈষ্ণব।

 নন্দ গোঁসাই গাইছে গুনগুন করে, নিজের বাঁধা গান! "এ এক আজব দেশে/বাউল জন্মায় গানের বসে"! কেন গানের বসে? এক কায়া দেহ অজয়! আর সেই ধর্ষিত অজয়ের কোলে হাঁটতে হাঁটতে, এ-ই সব ছাইপাঁশ কথা ভাবতে ভাবতেই, বেলা নামে পশ্চিমের আকাশে! ওপাড় থেকে ভেসে আসে, তরুণীর চিৎকার। "বাবা, বেলা যে গড়িয়ে যায়, বাসনায় আগুন দিবি না!" 

হঠাৎ কাঁদির লালাবাবুর কথা মনে পরে যায় তার, পিতার! চমকে ওঠে বৈষ্ণব সাধক। আত্মজাগরণের এই বাণীই কানে কানে, বেজে বেজে ঘুরে!

রাঢ় বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপ্তি দুর্নির্ণেয়! একদা দক্ষিণ বিহারে গয়া অবতার পূজনের একটি কেন্দ্র রূপে প্রসিদ্ধ ছিল। সে সময় সব শ্রেণির লোকরাই বৈষ্ণবধর্মের সমর্থক ছিলেন। 

রাজন্যবর্গ, গৃহী, বণিকগণ, সরকারের কর্মচারিগণ  বিশেষ ভাবে বিক্রমপুর পরগণার বারুজীবীগণ বিষ্ণুর অবতারের উপাসক ছিলেন। 

সেনবংশের রাজাদের রাজত্ব কালেও বৈষ্ণবীয় ভক্তি ভাব তেমন কিছু স্পষ্ট ছিল না। রাজা বল্লাল সেন "দানসাগর" গ্রন্থে "ভাগবতপুরাণ" এর উল্লেখ করেছিলেন। দৈত্যনিসূদন বিষ্ণুর পুজো গুপ্ত বংশীয় সম্রাটদের সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার একটি প্রকৃত উদাহরণ রূপে গণ্য করা হতো। সুপ্রাচীন "ব্যূহবাদ" এর প্রভাব কিছুটা অস্পষ্টভাবে দেখা যায়। ভাগবত ধর্মও সে দিনের অভিজাত মহলে, শাসক শ্রেণিতে কিছুটা জনপ্রিয় ছিল। 

অপরদিকে ত্রিপুরার ময়নামতিতে প্রাপ্ত রণবঙ্কমল্লের তাম্রলেখে ধর্মের অনুষঙ্গে "সহজ" শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যবহার থেকে ধারণা করা যায়, যে সহজিয়া বৈষ্ণবতারও কোনোও একটি ক্ষীণ ধারায় জীবিত ছিল। বৈষ্ণবরা বুদ্ধদেবকেও বৈষ্ণব অবতার রূপে শ্রদ্ধা করতেন। বঙ্গে সে দিনের ধর্মীয় সমন্বয়ের আদর্শ ছিলেন বুদ্ধ। তাই বহু প্রাচীন পন্থী টহল গানে বুদ্ধর ছায়া আছে।


নিত্যানন্দ নিত্যানন্দ, বুদ্ধ অবতার

তাহাদের মাঝে নাচে গৌরাগুণধর।

রাত গিয়ে প্রভাত আইলো,

শ্যামেরও সুহাগি

আচম্বিতে বাংলা ঘোরে, গৌরা গুণনিধি।

#######       ##########         ########        #####


প্রাচীর বৈষ্ণবধারার ঐক্য ধরে রেখেছিল "টহল"!


রাধামাধব মণ্ডল


আর কতো নিদ্রা যাওহে সখা, প্রভাতও হইলো

ওঠো ওঠো গৌরাচাঁদও, সুখ শারি ডাকে।

আর কতো নিদ্রা যাওহে সখা, বেলাযে পোহাইলো।

ওঠো ওঠো গৌরাচাঁদও, প্রেমমুরতি ওই ডাকে।


বাংলার বিভিন্ন জেলার মতো বর্ধমান জেলাতেও বৈষ্ণব ধর্মের তিনটি প্রধান ধারা প্রবাহিত হয়েছে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল পঞ্চোপাসনায় বিধৃত বৈষ্ণবধর্ম এবং বৈষ্ণবআচার।

পঞ্চোপাসনার অর্থে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে পঞ্চ দেবতার উপাসনাকে। সেই পঞ্চ দেবতারা হলেন বিষ্ণু, শিব, শক্তি, গণেশ ও সূর্য দেবতা।

বৈষ্ণবদের দ্বিতীয় ধারাটি হল গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম। এই ধর্ম শ্রীচৈতন্য অনুগামীদের মাধ্যমে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে প্রচারিত হয়েছিল।

বৈষ্ণবদের তৃতীয় ধারাটি হল লোকায়ত বৈষ্ণবধর্ম। এই ধর্মের কোনো কোনো মৌলিক সিদ্ধান্তের কথা কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর রচিত "চৈতন্য চরিতামৃত" থেকে গৃহীত হয়ে, আঞ্চলিক বিভিন্ন ধর্মীয় ভাব সেখানে ঢুকেছে। এই লোকায়ত বৈষ্ণবধর্মকে সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মও বলা হয়ে থাকে।

সেই ধর্মের বৃত্তে সহজ ভাবে নানান সামাজিক আচার বিচারও প্রবেশ করেছে। তেমন ভাবেই সহজিয়া বৈষ্ণবভাবে যেমন একসময় বাউল মিশেছে ঠিক তেমন ভাবেই বাংলায়, প্রাচীন এই বৈষ্ণবধারার সঙ্গে মিশেছে টহল সংগীত।

পরবর্তী কালে এক সময় বাংলাতে এই টহল সংগীতই লোকায়ত বৈষ্ণবদের সাধনসংগীত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

রাঢ় বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের এই ত্রিধারার স্রোতও বয়েছিল দীর্ঘ দিন। ত্রিধারার সঙ্গে শৈবশক্তি, শাক্তশক্তি, ধর্মপুজো, মনসাপুজো একই আসনে বসেছিল বাংলায়।

৫০০ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের মল্লসারুল গ্রামে একটি, তাম্রপত্রে রচিত লিপি উদ্ধার হয়। সেই লিপিতে চক্রক্ষেপনেরত বিষ্ণুর ছবি খোদিত ছিল। এবং লিপির ষষ্ঠচরণে কয়েকজন বৈষ্ণব ব্যক্তির নাম খোদিত ছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে মধ্য রাঢ়ের বর্ধমানে বিষ্ণুর অবতারের পুজো চালু ছিল।

ভাগবতপুরাণ কালক্রমে বর্ধমানে তথা রাঢ়দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয়। বৈষ্ণব ভাবাদর্শের ভিত্তি স্বরূপ এই পুরাণ আদি মধ্যকালে দাক্ষিণাত্যে সুশিক্ষিত শূদ্রা জাতিয় বৈষ্ণবদের হাত ধরে রচিত হয়। এবিষয়ে কোনো সন্ধেহ নেই।

বর্ধমানের কুলিনগ্রাম নিবাসী, বৃত্তশালী পরিবারের কায়স্থ বংশের মালাধর বসু "ভাগবতপুরাণ" অনুসারে "শ্রীকৃষ্ণ বিজয়" রচনা করে ছিলেন। জানা যায় মালাধর বসু সুলতানের দরবারে কর্মরত ছিলেন। বাংলার সুলতান বারবাক শাহ্ তাঁকে, "গুণরাজ খান" উপাধিতে সম্মানিত করে।

সে যুগের কুলিনগ্রাম, বর্ধমান জেলার একটি প্রাচীন গ্রাম। শ্রীচৈতন্যের সময়ে এই গ্রামে বৈষ্ণবধর্মের রমরমা তৈরি হয়। এবং গ্রামের সমস্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে এই বৈষ্ণবধর্ম জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রতি ঘরে সকাল সন্ধ্যে শ্রীখোল বাজতো। হতো নাম গান। 

মালাধর বসুর পৌত্র রামানন্দ ছিলেন চৈতন্যর ধর্ম আন্দোলনের সঙ্গী। সে সময় এই গ্রামে গোপেশ্বর শিবও পুজো পেতেন। 

মালাধরের পুত্র সত্যরাজ খান ছিলেন হরিদাসের পরিকর। যবন হরিনামও কিছুদিন কুলিনগ্রামে ছিলেন। এখনও কুলিনগ্রামে রয়েছে "হরিদাস গৌড়ীয় মঠ"। এই মঠে চৈতন্যকে পুজো করা হয়। আজও কথিত আছে, শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে গুণরাজ খান, পুরীতে রথযাত্রার সময় কুলিনগ্রাম থেকে ''পট্টদড়ি" পাঠাতেন। সুপ্রাচীন কুলিনগ্রামে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের পুজো আজও চালু রয়েছে। আজও পুরীতে দড়ি পাঠায় কুলিনগ্রাম।

সেই কুলিনগ্রামে এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল বৈষ্ণবদের জাগানোর গান বা টহল। এখনও কুলিনগ্রামের বহু মানুষ টহল গান করেন। বৈশাখমাসের সন্ধ্যবেলা কুলিনগ্রামে নামের বেড়া দেওয়া হয়, কার্তিকের ভোরে দেওয়া হয় টহল।

যদিও এখনও বহু বৈষ্ণব সাধক এই বৈশাখমাসের সন্ধ্যেবেলার নামগানকেও টহল বলেন। এই গানে থাকে না প্রভাতী আর্তি। তবে এই গানেও অন্তরআত্মার প্রতি আত্মনিবেদন থাকে, শিল্পী সাধক বা সাধক দলের। বাইরর জাগানো আর ভিতরের জাগানো, এই দুটিকেই টহল বলে।

বর্ধমানের কাটোয়া শহরে, সে সময় একটি শক্তিশালী বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। তার ঠিক পরে পরেই বাঘনাপাড়া ও কালনাতে বৈষ্ণবধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। হুগলি জেলার কাছাকাছি দক্ষিণ পূর্ব বর্ধমানে শৈবধর্ম জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন লোকধর্মও প্রচলিত ছিল, রমরমিয়ে। শৈবধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শাক্তধর্ম যেমন ছিল, তেমনই জনপ্রিয় ছিল ইসলাম ধর্মও। চৈতন্যের জীবনীকার এবং বৈষ্ণবধর্মের ধারায় অন্যান্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা করার কথা বলা হয়েছে। 

যদিও সুপ্ত ভাবে হলেও বৈষ্ণবদের তিনটি ধারার মধ্যেই রয়েছে বিরোধ। কোথাও কোথাও সেই বিরোধ রক্তিম হয়েও উঠেছে। তবুও প্রকৃত গৃহী বৈষ্ণবরা আজও অহিংসর কথা বলেন। তৃণের মতো ধৈর্য ও সহ্যের কথা বলে।

কোথাও কোথাও শাক্ত ও বৈষ্ণবের মধ্যেও রয়েছে বিরোধ। তবে এসবের উদ্ধে, বৈষ্ণবদের সাধনসংগীত টহল। 

সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আজও টহল গানের চর্চাক্ষেত্রে রয়েছে। সেখানে শিক্ষিত, অশিক্ষিত বলে কিছু নেই। মনের বৈরাগ্য এলেই একজন সামাজিক বৃত্তশালী মানুষও নেমেছেন টহল দিতে।

হেমন্তের ভোরের, সেই টহলগান গান একে অপরের আত্মজাগরণের পথকে করেছে সুগম। যুগ যুগ ধরে বাংলার বৈষ্ণবীয় সাধক সমাজ সেই পথ ধরেই এগিয়েছে। সেখানে কণ্ঠের রেওয়াজে মিলিত হয়েছে চৈতন্য, রাগাত্মিক, রাধাভাব, কৃষ্ণবন্দনার পাশাপাশি প্রভাতি সুরে নগরকীর্তনের  নামগান। এই সব পেড়িয়ে ভক্তিধর্মের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে টহল এসেছে এগিয়ে। গুরু পুজোকে

কেন্দ্র করে একদা যে বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে ফাটল ধরেছিল, আ চণ্ডালের মধ্যে প্রেম বিলীয়ে টহলই সেই বৈষ্ণবদের একত্রিত করছে, সে যুগের রাঢ় বাংলায়।