Wednesday 1 April 2020

লিংকটি খুলে ৭ পাতা খুলুন।

http://www.sukhabar.in/
নিভৃতপুরের গানওয়ালা রতন কাহার

রাধামাধব মণ্ডল

"বড়লোকের বিটি লো / লম্বা লম্বা চুল;
এমন মাথা বিন্ধে দিব / লাল গেন্দা ফুল৷"

নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সে আজও কাঁচা শীতের ভোরে মানুষটি হাঁটেন সিউড়ির পথে পথে। তিনি বাংলার প্রাচীন সাধন সংগীত টহলকে এখনও নিজের ভাষায় গান। জীবনের উপান্তে পৌঁছে মানুষটি হেমন্তের শীত কাতুরে ভোরবেলা গান গেয়ে ফেরেন ভাঙাচোরা গলায়। আজও এই অঞ্চলে তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন বাংলার হারাতে বসা প্রভাতী সাধন সংগীত টহলকে। একক পথ পরিক্রমা করে তিনি পথে পথে এগান গেয়ে ফেরেন, শুধু জীবিকার টানেই নয়। এই টহল গানের মাধ্যমেই তাঁর খ্যাত এবং গলার রেওয়াজ করা।
"কালো কি ছুঁলে কালো হয়/ওহে রাই তোমারে শুধাই।/পদ্মপুষ্প হয় না  কালো, ভ্রমর বসে মধুখায়/ আমায় ছুঁলে হবে কালো জেনেছো কি রাই কিশোরী /শীঘ্র করে খুলে ফেল পরণের ওই নীল শাড়ি।"
বাংলার পথে পথে, রাঙা ধূলোয় খঞ্জনি বাজিয়ে কীর্তন করা এমাটির অতি প্রাচীন এক সংস্কৃতি। কার্তিকের শুরুর দিন থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত নগরের পথে পথে এগান আজও গাওয়া হয়। এই ধারা ধরে রেখেছেন বীরভূমের এই নগর কীর্তনীয়া। 
এই সাধন সংগীত নিয়ে বলতে গিয়ে স্মৃতিমেদুর শিল্পী বলে উঠেন, ‘ছোটবেলায় অন্ধ নেপাল দাসের কাছে টহলের কয়েকটা পদ শুনেছি। আজও সেই গাই ভোরবেলায়।"
তিনি নিজেও প্রভাতী সাধন সংগীত টহল গান বেঁধেছেন।
রতন গানওয়ালা প্রায় দু’হাজার গান লিখেছেন।
 সিউড়ি শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের নগরী গাঁয়ের লম্বা মাটির উঠোন! তারই মাঝখানে দোচালা মাটির ঘর! সেখানেই চাঁদপানা ছোট্ট মেয়েটার একঢাল চুলে লাল ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে নিজের ট্র্যাজিক জীবনের কাহিনি তরুণ লোকশিল্পীকে শুনিয়েছিলেন কুমারী মা। পতিতা মায়ের গল্প। তন্ময় হয়ে সে গল্প শুনছিলেন শিল্পী। পিতৃপরিচয়হীন নিজের একরত্তি মেয়েটা সম্পর্কে কথায় কথায় বলেছিলেন কুমারী মা, ‘এই যে এত্ত চাঁদ রূপ মেয়ের, হবে না-ই বা কেনে? জানিসই বড়লোকের বিটি আছে বটে’। মা চেনে বাবার পরিচয়! এই গল্প থেকেই জন্মায় কালজয়ী সেই গান, ‘বড়লোকের বিটি লো’। ১৯৭২ সাল সেটা, তারও আগে হতে পারে। সে দিনের সেই তরুণ শিল্পী রতন কাহার এখন অশীতিপর। তিনি এই গল্প শোনার পর বেঁধেছিলেন গান! বসিয়েছিলেন নিজের মতো করে মাটির সুর! রজত কুমার সাহার মাধ্যমে, রতন কাহারের থেকে খাতা নিয়ে তিনটি গান গাইবার জন্য নেন স্বপ্না চক্রবর্তী।
 ১৯৭৬ সালে গানটির রেকর্ডিং করেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ তারপর সেই গান অশোকা রেকর্ড কোম্পানির দৌলতে লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে৷ জেতে গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কারও৷ এখনও একই রকম জনপ্রিয় গানটির স্রষ্টা রতন শুরুটা করেছিলেন আলকাপ দিয়ে। যাত্রার দলে ডাগরআঁখির ‘ছুকরি ’ সাজতেন৷ সং সাজতেন। তাতে দু'চার টাকা পেতেন। পরে তিনি নিজের উদ্যোগে তৈরি করেন ভাদু গানের দল৷ বেঁধেছেন অজস্র ঝুমুর গান৷ নেচে নেচে সে সব গেয়েছেনও। পুরস্কার, শংসাপত্র এত পেয়েছেন, যে একচিলতের ঘরে আর তা রাখার জায়গা নেই৷ এসব দিলে, মনে আনন্দও হয় না আর! এখন টাকা পেলে ছেলেদের হাত তুলে দেন, তাতেই বেজায় খুশি হয় গানওয়ালা রতন। সরস্বতীর বরপুত্রর লক্ষ্মীলাভ হওয়া সহজ কথা নয় কোনদিনই৷ এই গান ব্যস্ত মানুষটাই একদিন গান ছেড়ে দেওয়ার পথ ধরেন। চলে আসতে চান গানের পথ ছেড়ে! সাংসারিক তীব্র অনটনের কারণে এমনই স্থির করে জীবিকার প্রয়োজনে হাঁটতে শুরু করেন শ্রমের পথে! একসময় নিরন্তর দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় গান বাঁধা৷ তবে কি তাতে মন টেকে? সেই সঙ্কট কাটিয়েও ওঠেন একসময় রতন কাহার! তবে এই গানপাগল মানুষটার খ্যাতি জোটেনি তেমন, তবে মানুষের মনের কুলঙ্গিতে ঠাঁই পেয়েছে তাঁর সুর৷ বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম
 বাসিন্দা মানুষটা বিড়ি বেঁধে, খেতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন৷ অভাব অনটন নিত্যসঙ্গী জীবনভর আর তাকে সঙ্গে নিয়েই মহানন্দে হেঁটে চলেছেন লালমাটির পথে।
তিন ছেলে এক মেয়ের কেউই মাধ্যমিকের গন্ডি টপকাতে পারেনি পয়সার অভাবে৷ মেয়েটা ভালো গান গায়, কিন্তু একটা হারমোনিয়ামও কিনে দিতে পারেনি অসহায় বাবা রতন কাহার৷ মেয়েও বাবাকে নিয়েছে নিজের মতো।
এখন আর বিড়ি বাঁধার ক্ষমতা তেমন নেই৷ গানওয়ালা পারে না অন্য কাজও করতে! এখন সম্বল সরকারি ভাতা এবং অনুষ্ঠান করে পাওয়া, ওই ক'টা টাকা! ভেঙেছে শরীরের দেওয়াল! কৃষ্ণ কালো মাটির উপর দাঁড়িয়ে দুই চোখের কিনারে চলকে ভেসে আসে এক উজ্জ্বল আলো! তাতেই গিয়েছেন নিজের নৌকায় বিস্মৃতির আড়ালে৷ কে আর কদর করে তাঁর!
     লোক সংগীতের রসিক লোক ছাড়া, আর সকলেই তাঁকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে!
সেই কুমারী মা নিজের জীবনের সব গল্প বলেছিল রতনকে৷ ওঁর জীবনের আশ্রয়দাত্রী ছিল হরিদাসী৷ সেই প্রৌঢ়ার একটা ঝুমুরের দল ছিল৷ ওঁর কাছে থেকেই সুর নিতে গিয়ে তখনই আলাপ৷ সেই তরুণীর গল্পে এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন, যে গানটা লেখার সময় ওই গল্পটাই মাথায় ঘুরছিল রতন কাহারের৷ ইশারায়-ইঙ্গিতে সেই মেয়েকে বাবুর বাগানে দেখা করতে বলত তার প্রেমিকটি৷ অল্প বয়সে না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে মেয়ে৷ যখন টের পায় শরীরে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে, তখন পিতৃত্ব অস্বীকার করে প্রেমিক৷ সে তো তথাকথিত বড় ঘরের৷ শুরু হয় জীবনের টানাপোড়েনের লড়াই। তাই তার ঔরসে জন্মানো নিষ্পাপ শিশুটিকে উদ্দেশ্য করেই তৈরি হয় "বড়লোকের বিটি লো" গানটি।
     একসময় চুটিয়ে কাজ করেছেন আকাশবাণীতে৷ পাহাড়ি সান্যালই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভালোবাসার  আকাশবাণীতে। সেই কলকাতার শহর চেবা! দূরদর্শনেও করেছেন নিয়মিত কাজ! দুই মাধ্যমেই নিয়মিত কাজ করেছেন তখন, একটানা বেশ কয়েক বছর। অভিমান জড়ানো গলায় বলেন, ‘আমাকে নিয়ে অনেকেই ব্যবসা করেছেন৷ আমার লেখা , আমার বাঁধা গান নিয়ে এসে রেকর্ড করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন৷ সবাই আশ্বাস দেন৷ কিন্তু কিছুই হয় না৷" আবার মুহূর্তেই অবশ্য অভিমান গায়েব হয়ে শিশুসুলভ সারল্য ঝরে পড়ে উনার কণ্ঠে, ‘ওঁরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ মলয় বিকাশ পাহাড়ি,  আর্য চৌধুরী, আনন গোষ্ঠীর রাজকুমার সাহারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন আমার সঙ্গে৷ আনন গোষ্ঠীর সঙ্গেই এসে খাতায় বড়লোকের বিটি লো গানটা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ তবে তিনি রেকর্ড করার আগেই আমি গানটা গেয়েছিলাম রেডিয়োতে। 
পূর্ণচন্দ্র দাস বাউলও গেয়েছেন আমার গান, ভাঙা গলায় বললেন তিনি। তিনি আরও বললেন, আমার এই গান গুলি কিশোরী (দাশের) বাবুর "চন্দ্রভাগা" পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল। আরও বহু কাগজে হয়েছে ছাপা!
যাঁরা চিনেছেন -বুঝেছেন , তাঁরা কাজ দিয়েছেন রতন কে৷ তবে সময়ের দুর্বার স্রোতে ধীরে ধীরে কাজ কমতে শুরু করে রতনের জীবন থেকে৷ কেন্দ্রের পলিসিতে প্রসার ভারতী তার অনুষ্ঠানটা বন্ধ করে দেয় একসময়। পুরোনো মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অন্য জায়গায় চলে গেল বদলি হয়ে৷ আর তখন থেকেই রতন কাহারের জীবনে শুরু হয় আপাত অন্ধকারের ভাঁটা। থেমে যায় স্বাভাবিক ছন্দ। রতনের চিরকালের পছন্দের গান মাটির গান। আজও তাই ঝুমুর -ভাদুতেই ডুবে রয়েছেন তিনি৷ এখনও বাঁধছেন নতুন নতুন গান। নতুন প্রজন্ম খোঁজ নেয় না তেমন! তবে কেউ কেউ তাঁর কাছে আসেন আবেগ নিয়ে!
       শিলাজিতের জন্য ভাদু গান লিখেছিলেন তিনি৷ এই সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী শিলাজিৎ হাজার তিনেক টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন রতন কাহারের হাতে৷ তাতে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর কলেজে অনুষ্ঠান করে খুব প্রশংসা পান, সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে রতনের কথা শুনেছিলেন শিল্পী কালিকাপ্রসাদ৷ ২০১৭ মার্চে শেষ বার সিউড়ির অনুষ্ঠানে আসার পথে, রতন কাহারের বাড়িতে আসারও কথা ছিল! কিন্তু সে সময় দুর্ঘটনায় পড়ে তিনি চলে যান৷ 
       রতন কাহার বেঁচে আছে গাঁয়ের মাটিতেই! এই ভাবনার মানুষের সংখ্যা বাড়লেও, রতন কাহার আজও মাটির গহীন অন্ধকার কোণে বসে বাঁধছেন নতুন নতুন গান। মাটি, মানুষের গান।
যে মানুষটা গান কে তার নিজের কন্যাসম মানতেন, গানের কথা সুর কাউকে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতেন, বদলে কেউ টাকা দিতে এলে বলতেন, "আমি বিটি বিচে টাকা লুবো না।" কেউ জানতেও চায় না আর সেই মানুষটার কথা...
       "আমার গান শুনে যান ওগো বাবু, সুখেরই সংসারে /আমি এখন শুখনো পাতা, কখন যাবো পরে। "